বৃহস্পতিবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১৮, ০৮:৩৬:১৬

পর্দাবত’তে রাজপুতদের জয়গান, মুসলিম রাজাকে একপেশে সাংঘাতিক ভিলেনের তকমা

পর্দাবত’তে রাজপুতদের জয়গান, মুসলিম রাজাকে একপেশে সাংঘাতিক ভিলেনের তকমা

বিনোদন ডেস্ক : পর্দায় ইতিহাস (মানে করণী সেনার মতে ইতিহাস আর কী, আদপে ‘পদ্মাবতী’তো মালিক মহম্মদ জায়সির কলমেই) দেখাতে গিয়ে নতুন ইতিহাস গড়ে ফেললেন পরিচালক সঞ্জয় লীলা ভংসালী! একটা ছবি নিয়ে এত জলঘোলা ভারতের ইতিহাসে বোধহয় এই প্রথম। অগ্নিসংযোগ থেকে জহরব্রত পালন করার হুমকি— কী না হল!

তবে আফশোস একটাই, ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ‘পদ্মাবত’ মোটেই জায়গা করে নিতে পারল না। ছবি যে খুব খারাপ তা নয়, কিন্তু এই ছবির জন্য এত কাণ্ডেরও কোনও মানে নেই! করণী সেনার সদস্যরা বিভিন্ন রাজ্যে হিংসা না ছড়িয়ে সবাই মিলে ছবিটা দেখতে যেতে পারে। মনে হয় তারা খুশিই হবে। রাজপুতদের এত সুখ্যাতি, এত জয়গান এবং মুসলিম রাজাকে চোখ বন্ধ করে শুধুই সাংঘাতিক ভিলেনের তকমা দেওয়ার মতো এমন একপেশে দলিল আর কি কেউ কখনও পেশ করেছেন?

কে জানে! তবে যারা তাদের ‘রানি’র মান-সম্মান নিয়ে এতটাই চিন্তিত, তারা কিন্তু বেকারই ঢাল-তলোয়ার বার করে টিভি চ্যানেলগুলোয় বসছে। ‘সতী-সাবিত্রী’ ভারতীয় নারী বলতে যা বোঝায়, ছবিতে পদ্মাবতীকে ঠিক সেভাবেই দেখানো হয়েছে। সে রূপে-গুণে তো সর্বোচ্চ জায়গায় বসে আছেই, আবার রাজপুতদের মান ধরে রাখতেও রীতিমতো দক্ষ। কথায় কথায় সেই বাণীও আওড়ায়।

তবে এটা ঠিক যে, পরিচালকের কাঁধে প্রচুর দায়িত্ব ছিল। যে সংস্কৃতি মেয়েদের শেখায় ‘মান’ যাওয়ার চেয়ে জান যাওয়া অনেক ভাল, তেমন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সাহিত্যের পাতা থেকে এক রোমহর্ষক কাহিনি বেছে নিয়েছেন বানসালী। সেখানে তিনি জাত্যভিমান রক্ষা করবেন, নাকি জহরব্রতকে কতটা কম মহিমান্বিত করা যায় সেদিকে নজর রাখবেন, সেটা বোধহয় বুঝতে পারেননি। আর দু’য়ের মধ্যে ব্যালান্স রাখতে গিয়েই বোধহয় চিত্রনাট্যে ভারসাম্যটা হারিয়ে ফেললেন পরিচালক।

সেটা ঢাকতে যে পথটা বেছে নিয়েছেন, সেটা বানসালীর পক্ষে খুবই সহজ। নিজস্ব স্টাইলে ফ্রেমের পর ফ্রেম মুড়িয়ে দিলেন ‘গ্র্যাঞ্জার’এ। সেটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। যারা ‘বাজিরাও মস্তানি’ বা ‘...রামলীলা’ দেখেছেন, তারা এ ধরনের দৃশ্য আগেও দেখেছেন। সেগুলোরই একটু এদিক-ওদিক। কিংবা কোথাও হয়তো আরও বেশি বৈভব। কিন্তু এই দিয়ে আর কতদিন সিনেমাপ্রেমীদের মন ভরাবেন বানসালী! দর্শকও তো হাঁপিয়ে উঠে একটা সময় আসল গল্পের দিকে মন দেবেন! আর সেখানেই ফাঁক রয়ে গেল।

প্রথমার্ধে ছবির গতি একটু কম। বিরতির কিছুটা আগে থেকে সেটা অবশ্য মোটামুটি গতিপ্রাপ্ত হয়। তবে ছবির সব চরিত্র একদিকে। আর জিম সর্ভ অভিনীত কাফুরের চরিত্রটা অন্যদিকে। সে যখনই ফ্রেমে আসে কিংবা কথা বলে, মনে হবে একটা অন্য ছবি দেখছেন। যেটা একদমই বানসালীসুলভ নয়।

আলাউদ্দিন খিলজি যে বাস্তবে উভকামী ছিলেন, এবং তার বেশ কিছু পুরুষের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিল, তেমনটা কয়েকজন ইতিহাসবিদের মত। হয়তো সেই ছবিটার কিছুটা পর্দায় ধরতে চেয়েছিলেন পরিচালক। কিন্তু সেই অংশের ট্রিটমেন্ট এমনভাবে করেছেন যে, দৃশ্যগুলো অত্যন্ত হাস্যকর এবং বাকি ছবির থেকে খাপছাড়া লাগবে।

ছবির দ্বিতীয়ার্ধ টানটান। তবে শেষটা বসে দেখা খুবই অস্বস্তিকর। রানির আদেশে জহরের চিতা তৈরি হচ্ছে। হাজার হাজার মহিলা তাতে ঝাঁপ দিচ্ছে। এমনকী, বাচ্চা কিংবা গর্ভবতীরাও বাদ যাচ্ছে না। আর সেটা দেখে হাউসফুল হল’এর দর্শক যখন হাততালিতে ফেটে পড়ছেন, তখন মনে হবে শুরুর ডিসক্লেমারটা (এই ছবি ‘সতী’র মতো কোনও রকম প্রথা সমর্থন করে না) কি আদৌ কাজে দিল?

ছবিতে দীপিকা পাড়ুকোনকে সত্যিই ঐশ্বরিক দেখিয়েছে। পদ্মাবতীকে দেখে আলাউদ্দিনের স্ত্রী মেহেরুন্নেসা (অদিতি রাও হায়দরি) একবার বলবে, ‘আপনার সৌন্দর্য দেখে ভগবানও ভুল পথে চলে যাবে, সুলতান তো নেহাতই মানুষ’। ছবিতে দীপিকার সৌন্দর্য একবাক্যে তেমনই। আর অভিনয়? প্রত্যেকটা দৃশ্যে দীপিকার চোখের চাউনিই যথেষ্ট। প্রত্যেকটা ফ্রেমে বানসালী যেভাবে দীপিকাকে ধরেছেন, মনে হবে আলাউদ্দিন নয়, বানসালীর ক্যামেরাই দীপিকার জন্য পাগল।

শাহিদ কাপূরের এবার থেকে সেই পরিচালকদের সঙ্গেই কাজ করা উচিত, যারা তার অভিনয়ের মানের কদর করে সেই মতো তাকে ব্যবহার করতে পারেন। বিশাল ভরদ্বাজ, ইমতিয়াজ আলির পর সেই তালিকায় জুড়ল সঞ্জয় লীলা বানসালীর নাম। চিতোরের রাজা যে একা হাতে দিল্লির সুলতানকে টেক্কা দিয়েছিল, তাকে পর্দায় বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন শাহিদ। রণবীর সিংহের জোরাল পারফরম্যান্সের সামনে পর্দায় নিজের দিকে দর্শকের নজর টানা কম কথা নয়। সেটা দিব্যি করেছেন শাহিদ। তবে হেরে গেলেন দীপিকার কাছে। দীপিকার সবচেয়ে বেশি দৃশ্য শাহিদের সঙ্গেই। আর সবগুলোতেই শাহিদকে বলে বলে গোল দিয়েছেন দীপিকাই।

ছবির তুরুপের তাস রণবীর সিং। ইতিহাস আলাউদ্দিনকে কীভাবে মনে রাখতে চায়, সে বিষয়ে তর্ক করে লাভ নেই। তবে পরিচালক যে আলাউদ্দিনকে ধরতে চেয়েছেন, সেই চরিত্রে রণবীর সিং ছাড়া অন্য কেউ যে অভিনয় করতে পারতেন না, তা হলফ করে বলা যায়। সুলতান এ ছবিতে কখনও ভয়ংকর, কখনও পাগলাটে, কখনও প্যাশনেট, আবার কখনও হাস্যকর। প্রত্যেকটা মুহূর্তে যেভাবে রণবীর অভিনয় করলেন, তা তারিফযোগ্য বললেও কম বলা হবে। আলাউদ্দিনের পাগলামি, নৃশংসতা বহুদিন দর্শকের মনে থাকবে রণবীরের মাধ্যমে।

ছবির নাম নিয়ে যখন এতই সমস্যা, পরিচালক সহজেই ছবির নাম ‘খিলজি’ করে দিতে পারতেন। কাফুরের চরিত্রটা বেশ অদ্ভুত। তবে রণবীর আর জিমের রসায়ন অনবদ্য। দু’জনে যখন পর্দায় একসঙ্গে পাগলের মতো হাসছেন, খিলজি এবং তার ভৃত্যের পাশবিক আনন্দ দেখে দর্শকের গায়ে রীতিমতো কাঁটা দেবে।

শেষে একটাই কথা বলার। আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তি পাওয়ার আগেই যখন প্রিভিউ শো’গুলো হাউসফুল, এ ছবি যে ব্যবসা করবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কলকাতায় বসেও পর্দায় রাজপুতদের জয়গান শুনে যে এতো লোক হাততালি দিচ্ছেন, তারা কারা? তাদের কি সত্যিই রাজপুতদের বীরত্বের গল্প শুনে এত গর্ব হচ্ছে! তাহলে তো তারা সেই বার্তাটা করণী সেনার কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। অন্তত দেশে অহেতুক হিংসা ছড়ানোটা যদি তাতে বন্ধ হয়!
এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে