রবিবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৮, ০৯:০৩:৩০

সিনেমার পরিচালক যখন নিজেই টিকেট বিক্রেতা

সিনেমার পরিচালক যখন নিজেই টিকেট বিক্রেতা

মাহতাব হোসেন, দেবীগঞ্জ থেকে ফিরে : আমি ও মোসাদ্দেক; আমরা দুই বন্ধু রওনা দিলাম পার্বতীপুর থেকে। পার্বতীপুর অবিভক্ত ভারতের প্রসিদ্ধ রেলওয়ে জংশন। কলকাতা থেকে দার্জিলিং-এর সাথে যোগাযোগের জন্য এই রেলপথ নির্মাণ করা হয়, পরবর্তীতে আসাম ও বিহারের সাথে যুক্ত হয় পার্বতীপুর...আমরা অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি, যেটা বলছিলাম, পার্বতীপুরে এক নম্বর প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে রাজশাহী থেকে আসন্ন তিতুমীর এক্সপ্রেসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমাদের গন্তব্য প্রথমে নীলফামারীর ডোমার, সেখান থেকে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ।

ট্রেন এলো। মানুষ ভর্তি, থই থই। কোনোমতে উঠে পড়লাম। আগেই জানতাম ঈদের পরের দিন এমন ভিড় অস্বাভাবিক না। সৈয়দপুর আসার আগে আগেই সিট পেয়ে গেলাম। বসেও পড়লাম। সাথে মোসাদ্দেক। নীলফামারী থেকে আরেক বন্ধু উঠবে। ইফতেখার। নারায়ণগঞ্জের মদনগঞ্জ সোনালি ব্যাংক শাখায় সে চাকরি করে। বন্ধুদের দেখা হয় না। ফোনে একাধিকবার কথা হলো, যাতে ঠিক সময়ে নীলফামারী স্টেশনে সে উপস্থিত থাকে। নীলফামারী ট্রেন ঢোকার আগে তাকে ফোন দিলাম। সে বলল, ১০মিনিটের মধ্যে সে পৌঁছে যাচ্ছে স্টেশন। হিসেবে করে দেখলাম স্টেশনে ট্রেন ঢুকবে ৫-৬ মিনিটের মধ্যে। কিন্তু তার লাগবে ১০ মিনিট। ট্রেন যদি ২ মিনিট দাঁড়ায় তাহলেও তো ট্রেন মিস করবে সে। বারবার তাকে ফোন দিয়ে বললাম ফাস্ট ফাস্ট,কুইক কুইক...

আসল কথা বলতেই ভুলে গিয়েছি। এবারের ঈদে ৫ টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। ছবির সংখ্যা তো বেশ! এরমধ্যে ৩ টি ছবি দেশব্যাপী মুক্তি পেয়েছে। আর দুটি ছবির মধ্যে রোশান-ববির 'বেপরোয়া' মাত্র একটি হলে মুক্তি পেয়েছে। অন্যটি 'আহত ফুলের গল্প' প্রতিষ্ঠিত তারকার বাইরের এই ছবিটি কোনো হলে মুক্তি দেওয়া হয়নি। তার বদলে দেবীগঞ্জ উপজেলায় একটি অডিটোরিয়ামে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ নির্মাতার গ্রামের বাড়ি থেকে ছবিটির যাত্রা শুরু। মূলত এই নির্মাতার কাণ্ড কারখানা দেখতেই আমাদের এই যাত্রা।

শেষ পর্যন্ত ইফতেখার ট্রেন ধরতে পারেনি। জাস্ট এক মিনিটের জন্য ট্রেন মিস করেছে। ওকে বললাম বাসে চলে আসতে। আমরা যখন ডোমারে নামলাম তখন সূর্য মধ্য আকাশে। প্রচণ্ড গরমে প্ল্যাটফরমে পায়চারি করতে লাগলাম। প্ল্যাটফরমের চায়ের দোকান থেকে চা খাই, কোক খাই; সময় কাটে না। প্রায় ৩০ মিনিট পরে ইফতেখার বাস সহযোগে এলো। এরপর আমরা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে আধঘণ্টার মধ্যে দেবীগঞ্জ চলে এলাম। 
সেখানেই আমাদের সঙ্গে যোগ দিল সাকোয়া থেকে সুমন। তার সাথেও দেখা হয় না। থাকে কেরানীগঞ্জে, চাকরি ব্যাংক এশিয়ায়। এই সুযোগে তার সাথে দেখা হবে না তা কি হয়!

মানুষকে বলে বলে খুঁজে বের করলাম টাউন হল ক্লাব। এখানেই প্রদর্শিত হচ্ছে 'আহত ফুলের গল্প। ' অন্ত আজাদকে খুঁজতে গিয়ে তাকে খুঁজে পেলাম টিকেট কাউন্টারে। তিনি টিকেট বিক্রি করছেন। একজন নির্মাতা টিকেট বিক্রি করছেন- ভাবা যায়! শুধু তাই নয় প্রদর্শনীর সময়সূচি জানিয়ে মাইকিং করছেন তিনি নিজেই। আমাদের দেখে অন্যজনকে টিকেট বিক্রির দায়িত্ব দিয়ে বাইরে বের হয়ে এলেন।

আমাদের নিয়ে বসালেন কাউন্টারেই। দুপুরে খাবারের সময় হয়ে গেছে। বাসা থেকেই খাবার আনালেন। মাছ মাংস। মানে তিনি কী দিয়ে আপ্যায়ন করাবেন ভেবেই পাচ্ছেন না। তাকে থামালাম। শুনতে চাই এমন উদ্যোগের গল্প। অন্ত আজাদ দেবীগঞ্জে অবস্থানকালীন জানালেন পুরো গল্প।

আহত ফুলের গল্পের একটা বড় অংশ শুটিং করেছেন দেবীগঞ্জে। শুটিং হয়েছে উপজেলার বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া করতোয়ায়। আর তাই চেয়েছেন প্রথমে নিজ এলাকার মানুষকে চলচ্চিত্রমুখী করবেন। কেননা এই উপজেলায় দুই সিনেমা হল ছিল। সেগুলো বন্ধ। 'আমার টকিজ' নামের একটি সিনেমা হল ছিল; বেশ কয়েক বছর আগে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। তার আরও আগে সমাজের সচেতন মানুষ হলমুখী হওয়া বাদ দিয়েছেন।

পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল সেই হল। মালিকানা টাউন হল ক্লাবের। তারাও সেটাকে ফেলে রাখে। আর এখানেই অন্ত আজাদ ছবিটি প্রদর্শনীর পরিকল্পনা করেন। বিদ্যুৎ ছিল না। তার টেনে বিদ্যুৎ নিয়েছেন। ওয়াশরুম নষ্ট ছিল, সেগুলো পরিস্কার করিয়েছেন। পলেস্তারা খসে পরেছিল, সেগুলো চুনকাম করিয়েছেন। মানুষের যাতায়াতের পথ ঠিক করেছেন। ছাড়পোকা খাওয়া সকল চেয়ার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ভেতরে পরিস্কার করিয়েছেন। ওপরতলা নিচ তলায় চেয়ার ভাড়া করে এনেছেন। গরমে দর্শক যাতে কষ্ট না পায়, সেজন্য ফ্যানের ব্যবস্থা করেছেন।

আর এসবের কল্যাণে অনেকদিন পর দেবীগঞ্জবাসী দেখতে পাচ্ছে চলচ্চিত্র। যে ছবি দেখে আনন্দময় কষ্ট নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। কারো কারো চোখে জল। কারণ এতো সুন্দর ঝকঝকে পর্দায় এতো দুঃখ মিশ্রিত ছবি স্বাভাবিকভাবেই হৃদয় স্পর্শ করছে। কেউ কেউ আবার দুই তিনবার দেখে ফেলছে। আমরা ওখানে ছবি দেখার সময়ই কয়েকজন দ্বিতীয়বার ছবিটি দেখতে এসেছিল। সবকিছু মিলিয়ে নির্মাতা অনুপ্রাণিত। কেননা তিনি ভাবেন নি এতো মানুষ সাড়া দেবে।  

অন্ত আজাদ বলেন, আমরা লড়াই করছি। মানুষজন আবার হলমুখী হবে। যতটা সম্ভব নিজ অবস্থান থেকে এই সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। পাশে মানুষজনকে পাচ্ছি সাহস পাচ্ছি। এই যে এতো মানুষ আগ্রহ নিয়ে হলে আসছে, ছবি দেখছে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে- এটাই আমার সাহস।-কালের কণ্ঠ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে