হিন্দু বাজিরাও এবং তার মুসলিম বউয়ের আদ্যপান্ত
বিনোদন ডেস্ক : হিন্দু পেশোয়া বিয়ে করছেন এক মুসলিম রমণীকে। ইতিহাসে এমন নজির তেমন একটা দেখা যায় না। বরং উলটোটারই প্রাধান্য বেশি। তা সত্ত্বেও যোধা-আকবরের মতোই জনপ্রিয় এই হিন্দু পেশয়া বাজিরাও ও তার মুসলিম স্ত্রী মস্তানির কাহিনিও।
কে এই মস্তানি? জানা যায়, তিনি বুন্দেলখন্ডের রাজা ছত্রসলের কন্যা। বাবা হিন্দু হলেও তার মা ছিলেন একজন মুসলিম। যদিও তার পিতৃপরিচয় নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ কেউ বলেন তিনি হায়দরাবাদের নিজামের কন্যা।
যারই কন্যা হোন না কেন, মস্তানি যে জন্মসূত্রে মুসলিম পরিবারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তা নিয়ে সন্দেহ নেই। ছত্রশলের কন্যা হলেও তাকে আধা-মুলিম বলা যায়। এই মস্তানির সঙ্গে বাজিরাওয়ের আলাপও বেশ ধোঁয়াশার। কোনও কোনও ইতিহাসবিদের মতে, বাজিরাওয়ের সাহায্যে রাজা ছত্রশল যুদ্ধ জিতলে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রাজ্যের একাংশ ও মেয়ে মস্তানিকে বাজিরাওয়ের হাতে তুলে দেন। কেউ কেউ মনে করেন মস্তানি বাঈজি ছিলেন। ধনী মুসলিমদের কোঠায় তিনি নাচ-গান পরিবেশন করতেন। মুসলিমদের বিরুদ্ধে বাজিরাওয়ের যুদ্ধ হলেও, মস্তানির রূপলাবণ্যে মুগ্ধ হন তিনি। তাকে বিয়ে করেন৷ কিন্তু এ বিয়ে সুখের হয়নি। বাজিরাওয়ের প্রথম স্ত্রী কাশীবাঈ এবং বাজিরাওয়ের পরিবার খানিকটা ঈর্ষায় আর খানিকটা সংস্কারের বশে মস্তানিকে পরিবারের একজন হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু বাজিরাও তাকে পাগলের মতো ভালবাসতেন৷ শোনা যায়, বাড়িতে হোক কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি মস্তানিকে সবসময় নিজের পাশে রাখতেন। মস্তানির গর্ভে পেশোয়া বাজিরাওয়ের এক ছেলে হয়। বাজিরাও নিজে তার নাম রাখেন শামসের বাহাদুর৷ কিন্তু শামসেরকে তিনি পরিবারে প্রতিষ্ঠা দিতে পারেননি৷ আনুষ্ঠানিক রীতি পালন করতে অস্বীকার করেন পরিবারের পুরোহিত৷ আর সেই সূত্রেই বাজিরাওয়ের পরিবারের সদস্যরা মস্তানিকে তাঁর থেকে আলাদা করে দেয়৷ এরপরেই বাজিরাও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ ১৭৪০ সালে তাঁর মৃত্যু হয়৷ সে বছর মৃত্যু হয় মস্তানিরও৷ কেউ কেউ বলেন, মস্তানি সতীদাহ প্রথা পালন করে সতী হয়েছিলেন৷
ইতিহাসে হিন্দু-মুসলিম বিবাহ অবশ্য নতুন কিছু নয়৷ মুঘল আমলে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ পাওয়া যায়৷ মুঘল সম্রাট আকবর রাজপুত রমণী যোধাবাঈকে বিয়ে করেছিলেন বলে শোনা যায়৷ যদিও সে তথ্য নিয়ে মতভেদ আছে৷ আরও রাজপুত রমণীর নাম উঠে আসে এই সূত্রে৷ যোধাবাঈকে আকবর বিয়ে করেছিলেন কি না, নাকি ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন, তা নিয়ে সংশয় থাকলেও রাজপুত রমণীরা যে মুঘল সম্রাটদের অন্তঃপুরে জায়গা করে নিয়েছিলেন তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই৷ কেননা আকবর পরবর্তী মুঘল সম্রাটদের ক্ষেত্রেও হিন্দু স্ত্রীর উল্লেখ পাওয়া যায়৷
তুলনায় হিন্দু কোনও রাজার মুসলিম ঘরণীর নিদর্শন প্রায় বিরল৷ বাজিরাও ও মস্তানির কাহিনি তাই সে নিরিখে স্বতন্ত্র। শোনা যায়, ছত্রপতি শিবাজী একবার এক মুসলিম রাজকুমারীক দেখে পছন্দ করেছিলেন৷ তিনি নিজে না বিয়ে করলেও, ছেলের সঙ্গে সেই রাজকুমারীর বিবাহ দেবেন ঠিক করেছিলেন৷ কিন্তু শেষপর্যন্ত সে সিদ্ধান্ত তিনি বদল করেন।
কেননা তাঁর মনে হয়েছিল, মুসলিমদের রাজ্য বিজয় করলেও তিনি তাঁদের বিয়ের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। অবশ্য মধ্যযুগে হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির যে মিশ্রণ ঘটেছিল তাতে অনেকটাই ভূমিকা নিয়েছিল দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈবাহিক আদানপ্রদান৷
বাজিরাও, মস্তানির ঘটনা স্বতন্ত্র বলেই বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে চলচ্চিত্র পরিচালকদের৷ ধীরুবাই দেশাই ১৯৫৫ সালে তাঁদের জীবন নিয়ে ‘মস্তানি’ নামে একটি সিনেমা করেন৷ এন এস ইনামদারের উপন্যাস অবলম্বনে নয়ের দশকে মারাঠি সিরিয়াল ‘রাও’তে উঠে এসেছিল তাঁদের জীবনকথা৷ ‘শ্রীমন্ত পেশয়া বাজিরাও মস্তানি’ নামে আরও এক সিরিয়ালে এসেছিল তাঁদের কথা৷ এই কাহিনির টানেই পরিচালকসঞ্জয় লীলা বনশালি তৈরি করেছেন তাঁর ‘বাজিরাও মস্তানি’৷ ১৮ ডিসেম্বর মুক্তি পাচ্ছে সে ছবি৷ ইতিহাস থেকে উদ্ধার করে, নানা মতভেদের বেড়া টপকে সঞ্জয় এ কাহিনিকে কীভাবে পরদায় তুলে আনবেন, তা দেখতেই এখন উদগ্রীব অপেক্ষা সিনেপ্রেমীদের। কলকাতা২৪
১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমএন
�