চার্লি চ্যাপলিন : ডুবন্ত সভ্যতার বেহুলার ভেলা
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় : যেন অলৌকিক সমাপতন যে পৌষের শীতে গোয়ালঘর আলো করে মা মেরির কোলে এলেন ফুটফুটে দেবতা আর তার পর পৃথিবী মাত্র উনিশশো সাতাত্তর বার পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরেছে। সেই একই দিন— বড়দিনে চলে গেলেন চার্লি চ্যাপলিন। যদি খ্রিস্ট আজ দণ্ডিত হতেন তবে আমি নিশ্চিত যে, বধ্যভূমিতে একুশ কাঠের সঙ্গে তার সঙ্গী হত একটি টুপি আর একটি ছড়ি। চার্লি চ্যাপলিন তো কোনও কৌতুকাভিনেতা নন।
তিনি আমাদের মলিন আত্মাকে স্নান করিয়ে দেন। যে মানুষের মাথায় ইডিওলজি বা ধর্মের তেরপল নেই, যে অনাথ বালকের মতো অসহায়, বিনা দোষে যে নাজেহাল হয় বারে বারে, সেই নিতান্ত গোবেচারা মানুষের যে ছবি আমাদের মনে দেশ-জাতি-বর্ণ-ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবে তৈরি হয়ে আছে বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে, তা নির্বিকল্প চ্যাপলিনেরই।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘তোমারে পাছে সহজে বুঝি, তাই কি এত লীলার ছল/বাহিরে রবে হাসির ছটা, ভিতরে থাকে আঁখির জল।’ এই কথায় যদি এক জনের প্রসঙ্গও পুরোপুরি থাকে, তবে তিনি এই বেমানান কমেডিয়ান। তার ছবি দেখে প্রথমে হো হো করে হাসি আর একটু পরেই দেখি হাসির এই পদ্মপাতায় টলমল করছে অশ্রুবিন্দু। মার্কিন নির্বাক কমেডির নট বললে উড়ন্ত ঈগলের ডানা ছেটে দেওয়া হবে।
পরিচালক ও অভিনেতা, নির্বাক ও সবাক— দুই যুগেই তিনি উপমা-রহিত। বিস্ময়ের থরে থরে সাজানো প্রদর্শশালা। যেন এক জ্যান্ত রূপকথা, যেন এক মুখোশ পরা রাজপুত্তুর। যাকে দুর্দশায়, ঘামে আর কান্নায় রোজনামচা মনে হয়। অথচ চোখ সরালেই তিনি মহাকাব্য। রবীন্দ্রনাথ বা চার্লি বললে পৃথিবী নামের এই গ্রহে কোনও পদবীর দরকার হয় না। সসাগরা ধরিত্রী আর নীলিমা এই ভবঘুরে ও বিদূষকের সম্মানে সুন্দর হয়ে উঠল আরও।
দূরে কাছে কেবলই ঘর ভাঙে, গ্রাম পতনের শব্দ হয়। তখনই মনে পড়ে চার্লিকে উদ্বাস্তু, অনাহূত, অপমানিত। বরং তার তুলনায় কম পরিচিত একটি ছবির কথাই বলি। সে ছবি ১৯২২ সালের। নাম ‘দ্য পিলগ্রিম’। সেখানে চার্লি আর কয়েক জন অপরাধী জেল পালিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক ছোট শহরে হাজির। এক ভদ্রলোকের স্নান করার সুযোগ নিয়ে তার জামাকাপড় চুরি করে চার্লির শহরে ঢোকামাত্র বাসিন্দারা ভাবে, এ বোধহয় শহরের নতুন পাদ্রি যার অপেক্ষায় তারা বসে আছে।
যথারীতি অন্যের ভূমিকায় চার্লিকে অভিনয় করতে হয়। গির্জার বেদি থেকে সে বাণী বিতরণের বদলে ডেভিড ও গোলিয়াথের গল্পটা মূকাভিনয় করে দেখায়। সেই শহরে নানারকম হাস্যকর আদবকায়দা আর মুদ্রাদোষ সামলে সে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এমন সময় এক দিন তারই আরও এক জেল পালানো স্যাঙাৎ তার বাড়িওয়ালির বাড়িতে ডাকাতি করতে এলে চার্লি প্রচণ্ড লড়াই করে সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। শহরের শেরিফ কিন্তু আসামী চার্লিকে চিনে ফেলেছিল। কিন্তু চার্লির মহানুভবতায় যে সারা শহর পাগল! অগত্যা শেরিফ ঠিক করেন, তিনি চার্লির পালানোর ব্যবস্থা করে দেবেন। অন্তিম দৃশ্যটি যেন মহাভারতের মহাপ্রস্থানপর্ব!
অশ্বারোহী শেরিফ চলেছেন আমেরিকা। আর মেক্সিকোর সীমানার পাশ দিয়ে, হেঁটে হেঁটে পাশেপাশে চলেছে চার্লি। শেরিফ চান সীমান্ত পার হয়ে মিলিয়ে যাক চার্লি। কিন্তু চার্লি তো ভারি সরল, ইশারাটাও বুঝতে পারে না। নিরুপায় হয়ে শেরিফ তাকে ওপারে পাঠান কিছু বনজ কুসুম তুলে আনতে। বোকা চার্লি সেগুলো তুলে আবার এ দিকে চলে আসে। অবশেষে ক্লান্ত নগরপাল তাকে লাথি মেরে ওপারে ফেরত পাঠিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে উধাও হয়ে যান।
চার্লি পালাবে কোথায়? ওপারে তখন একদল ডাকাত নিজেদের মধ্যে লড়াই করছে। হায় রে মুক্তি! হায় স্বাধীনতা! চার্লি তখন এক দিকে আমেরিকা আর এক দিকে মেক্সিকোকে রেখে তার বিখ্যাত পাতিহাঁসের মতো হাঁটা হাঁটতে থাকে। হয়ে ওঠে দিশাহারা, নির্যাতিত মূক, গরিব মানবপুত্রের স্থায়ী প্রতীকচিহ্ন। নানা দিক থেকে দেখলে আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের শিশুতীর্থ যেমন, চ্যাপলিনের তীর্থযাত্রাও তেমন। ভীতি ও বিপর্যয় সত্ত্বেও তারা ঝলমল করে ওঠে দেবতার রক্তে রাঙানো করবী কুসুমের মতো।
আজকের পৃথিবীর এই রণ-রক্ত-সফলতায় চার্লি যখন বলে ওঠেন— ‘এক জনকে খুন করা হলে সে খুনি, লাখো লাখো মানুষকে খুন করলে সে বীর, সংখ্যাই বিশুদ্ধ করে।’ অথবা এমন সময় আসে যখন খুনকে মনে হয় মস্করা। তখন মনে হয় এপিটাফ লেখার দায়িত্ব ইতিহাস তাকেই দিয়েছে। চূড়ান্ত বিনোদনকে যে মারাত্মক অন্তর্ঘাতের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়। অমোঘ আমোদের আস্তিনে যে লুকিয়ে রাখা যায় অসম্ভব যন্ত্রণা, হেরে যাওয়া মানুষের হাসি যে কত মর্মান্তিক হতে পারে তা দেখতে গেলে ষোড়শ শতকে জন্মাতে হয়; নাম নিতে হয় উইলিয়াম শেক্সপিয়র।
নয়তো বিশ শতকে জন্ম নিতে হয়। স্বভাবত নাম পাল্টে নিতে হয় চার্লি চ্যাপলিন। কি ছোট্ট, যেন চিনে তুলির আঁচড় দিচ্ছেন ক্যামেরায় ‘ইমিগ্র্যান্ট’ ছবিতে এক দিকে আগন্তুকদের পশুর মতো গাদাগাদি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, অন্য দিকে স্ট্যাচু অব লিবার্টি। চ্যাপলিন সে দিকে তাকান। সে দৃষ্টি একমাত্র চ্যাপলিনেরই থাকতে পারে। মার্কিন গণতন্ত্র থরথর করে কেঁপে ওঠে। অথচ, চ্যাপলিনকে মিছিল করতে হয় না। স্লোগান দিতে হয় না। অথচ হোয়াইট হাউজ বেআব্রু হয়ে পড়ে বারে বারে।
এই যে উদ্ভট পোশাক, বড় জুতো, ঢলঢলে পাৎলুন, খাটো কোট, পুঁচকে প্রজাপতি গোঁফ। বিশ্ববিখ্যাত টুপি আর লাঠি সহযোগে সিনেমার পর্দায় তিনি বিশ্বজয় করতে পারলেন কেননা চার্লি ‘সুস্থ সমাজে’ বেখাপ্পা, ফালতু, প্রান্তিক। গল্পের কোথাও তার থাকার কথা নয়, সে তবু হয়ে যায় মূল চরিত্র। চার্লি যেন আয়নার ফাটা দাগ, যতই এড়াতে চাই পারি না।
যা অনভিপ্রেত, সভ্যতা যাকে প্রসাধনে ঢেকে রাখতে চায়, চার্লি চ্যাপলিন হাসতে হাসতে দেখিয়ে দেন আমাদের মুখ ভর্তি ব্রনর দাগ! এতটুকু তিক্ততা নেই। আমরাও হেসে ফেলি। ঔপন্যাসিক দস্তয়েভস্কির দার্শনিকতা যাদের ‘ভূতলবাসী’ বানায় তারাই বিদূষক চার্লির উপাদান— অনামী মানুষ। যে অমানবিকীকরণের কথা চার্লি দেখান কারখানায় জনৈকা তরুণীর নিতম্বে রেঞ্জ দিয়ে টাইট দেওয়ার সময়, সেই মডার্ন টাইমস যদি বাংলায় লিখিত হত তার নাম হত রক্তকরবী। লিখতেন রবীন্দ্রনাথ। কারখানায় কাজ করতে করতে পাগল হয়ে যাওয়া মানুষটি তো আমাদেরই সহোদর!
সত্যজিৎ তার সম্মানে উঠে দাঁড়ান, উদ্ধত গোদার নম্র হয়ে জানান— ‘মানবিক অভিধাটি কেবল তারই প্রাপ্য’, রসেলিনি বলেন, ‘এক স্বাধীন মানুষ!’ চ্যাপলিনকে তাই অভিনেতা বা পরিচালক বলা অপ্রাসঙ্গিক। তিনি একটি ডুবন্ত সভ্যতার বেহুলার ভেলা। পৃথিবীর কোটি কোটি লাঞ্ছিত মানুষ আর কাকে দেখলে ভাবতে পারেন— ‘খ্রিস্ট পুনরুত্থিত হয়েছেন’!
আমাদের বড়দিনকে আপনি আরও বড় করে দিলেন রাজাধিরাজ চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন!
লেখক : যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক। সৌজন্যে : আনন্দবাজার
২৬ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস
�