নৌকাডুবি চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীতে ডুবে মারা যেতে ধরেছিলেন ছবিটির নায়ক। তাঁকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে প্রাণে বাঁচায় ১৫ বছরের এক কিশোরী। নায়কের নাম ধীরাজ ভট্টাচার্য।
ঘটনাটি আজকের নয়, মাত্র ৯০ বছর আগের। এরপর অসংখ্যবার 'নৌকাডুবি' চলচ্চিত্রটি বানানো হয়েছে। কিন্তু নরেশ মিত্রের পরিচালিত প্রথম নৌকাডুবির ঘটনা তো কারণে অকারণে চলে আসবে, নতুন প্রজন্মের সামনে উন্মোচিত হবে। ভারতীয় চলচ্চিত্রে বাংলা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির ভূমিকা সুদূরপ্রসারী। পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছবি 'দেনা পাওনা' ১৯৩১ সনের ৩০ ডিসেম্বর শুভমুক্তি পেয়ে কলকাতার চিত্রা সিনেমা হলে প্রথম প্রদর্শিত হয়।
কিন্তু প্রথম সবাক চলচ্চিত্র হতে যাচ্ছিল নরেশমিত্রের এই 'নৌকাডুবি'ই। কিন্তু এর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ম্যাডান কোম্পানির সঙ্গে রবীন্দ্র ভারতীর কপিরাইটের অর্থমূল্য নিয়ে বনিবনা হচ্ছিল না। কেননা ম্যাডানের নির্বাক কপিরাইট নেওয়া ছিল। সবাকের জন্য মোটা অংকের টাকা দিতে হবে। শুধু এটাই নয়, আরেকটি কারণ বর্তমানে টালিগঞ্জের ইন্দ্রপুরী স্টুডিও যেখানে, ম্যাডান কোম্পানির শুটিংয়ের জায়গা। পরে নাম পালটানো হয়েছে রায় বাহাদুর কিনে নেওয়ার পর।
যাই হোক, সবাক চলচ্চিত্রের সমস্ত প্রতুতি নেওয়া হয়েছে, ফ্লোর কমপ্লিট যন্ত্রপাতি নিয়ে আসা থেকে শুরু করে সব কাজই সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু যারা 'টকি' নেবেন সেই মার্কিন দল কলকাতায় এসে পৌঁছাননি, তারা কিছুদিন পরে আসবেন।
কিন্তু নৌকাডুবি নিয়ে তো বসে থাকা যায় না। ১৯৩১ সালের ঘটনা। সিরাজগঞ্জে ভয়াবহ বন্যা হলো। কলকাতার কাগজে নরেশ মিত্র দেখলেন নৌকাডুবির দৃশ্য ধারণের উত্তম সময়। কেননা কোথায় নৌকা ডুবানো হবে এমন জায়গা কোনোভাবেই পাচ্ছিলেন না নরেশ। পত্রিকায় ঐ খবর দেখে আগ্রহী হলেন যে সিরাজগঞ্জে শুটিং করবেন।
কলাকুশলীসহ সিরাজগঞ্জে এলো 'নৌকাডুবি' দল। কিন্তু এ কি। স্টেশন আর কোথায়। সব ডুবে একাকার। মৃত মানুষ, পশুপাখি বন্যার পানিতে ভেসে যাচ্ছে। যমুনা গ্রাস করে নিয়েছে পুরো সিরাজগঞ্জ। এগিয়ে এলেন একজন আইনজীবী। তাঁর নাম অন্তিম কুমার বসু। যিনি নিজেও অভিনয়ে আগ্রহী ছিলেন। নিজের একটুকরো শুকনো জায়গা আর একটি লঞ্চ (গাধাবোট) এ জায়গা দিয়ে পুরো দলকে রাখা হয়। পুরো বিষয়টি ধীরাজ তাঁর রচিত 'যখন নায়ক ছিলাম' উপন্যাসে বর্ণনা করেছেন।
বন্যায় স্থানীয় উদ্ধারকারী দল কিছুতেই এই শুটিং করতে দেবে না। কেননা নায়িকা সুনীলা নৌকা থেকে পড়লে তাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। যমুনায় ভয়ঙ্কর স্রোত। সেই স্রোতের মধ্যে নৌকা ডুবানো হলে অন্তত কলকাতা থেকে আসা নায়িকাকে বাঁচানো যাবে না, এমন মত দিয়ে স্থানীয় যুবকরা আপত্তি জানালেও পরিচালক নরেশ কানে তুলছিলেন। শেষ পর্যন্ত একটা ব্যবস্থা হয়। কনের নৌকার সঙ্গে সাহসী, তিনবারের সাঁতার চ্যাম্পিয়ন ১৫ বছরে কিশোরী জয়াকে নেওয়া হয়।
আরেকটা নৌকায় ক্যামেরা ক্রু। আগে বরের নৌকা ডুববে। তারপরে কনের। বরের নৌকা ডুবলো লাফ দিলেন নায়ক ধীরাজ। ক্যামেরা চলে গেল সুনীলার নৌকায়। শট ওকে। স্থানীয় ব্যায়ামসংঘের উদ্ধারকারী দলরা তৎপর ছিল। স্রোতে যারা ভেসে যাচ্ছিল তাদের উদ্ধার করলো। কিনবতু যখন খেয়াল হলো নায়কের কথা, তখন ধীরাজকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
ডুবে ভেসে গিয়েছিলেন ধীরাজ। আটকে ছিলেন এক ভেন্ডার ডালে। ধীরাজকে খুঁজতে জয়া দেখতে পায় ওর চেলি (ধুতি বা লুঙ্গি) লাফ দিয়ে ধীরাজকে টেনে নৌকায় তোলা হয়। বেঁচে আছেন কি মরে গেছেন সেটা বোঝা মুশকিল ছিল কেননা পানি খেয়ে ঢোল হয়ে গিয়েছিলেন। পরে বালিশ ও কম্বল চাপা দিয়ে পানি বের করা হয়। ২৪ ঘণ্টা পরে জ্ঞান ফিরেছিল ধীরাজের।