শুক্রবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৩, ০৮:১৫:২৮

বলিউডের জন্য এক অশনিসংকেত ‘করপোরেট বুকিং’

বলিউডের জন্য এক অশনিসংকেত ‘করপোরেট বুকিং’

শঙ্খনীল দেব: সিনেমাপ্রেমীদের জন্য ভালো সিনেমা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সিনেমার আয়ও গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। বর্তমানে সিনেমা দেখার পাশাপাশি সিনেমার আয়-ব্যয় নিয়েও দর্শকমনে আগ্রহের শেষ নেই। আর এটি অবশ্যই ভালো একটি দিক। উপমহাদেশীয় অঞ্চলে সিনেমাপ্রেমীদের উন্মাদনার শেষ নেই।

আর এই অঞ্চলে সবচেয়ে বড় উন্মাদনার নাম বলিউড। সাম্প্রতিক সময়ে বলিউডের সাফল্যের পাশাপাশি একটি শব্দ সিনেমাপ্রেমীদের কাছে পরিচিত হচ্ছে, সেটি ‘করপোরেট বুকিং’।

বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চলচ্চিত্রশিল্প বলিউডের সঙ্গে করপোরেট বুকিং শব্দের যোগসূত্র ঘনিষ্ঠভাবেই তৈরি হয়েছে। করপোরেট বুকিংয়ের মাধ্যমে বড় বড় তারকার চলচ্চিত্র বক্স অফিসে সফল করা হচ্ছে, তৈরি করা হচ্ছে বাড়তি উন্মাদনা।

যার প্রভাব পড়ছে দর্শকমহলে। তবে সেই প্রভাব পুরোটাই নেতিবাচক। এ বছর পাঠান, জওয়ান, টাইগার ৩, রকি অউর রানি কি প্রেম কাহানি, সালার-এর মতো সিনেমা করপোরেট বুকিংয়ের মাধ্যমেই সাফল্য পেয়েছে, এমনটাই অভিযোগ উঠছে সাধারণ দর্শকদের কাছ থেকে। কিন্তু কি এই করপোরেট বুকিং?

সিনেমা ও বক্স অফিসে কিভাবে এটি প্রভাব ফেলে? করপোরেট বুকিংয়ের ফলে কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলিউড তথা ভারতীয় সিনেমা শিল্পগুলো? চলুন জেনে নেওয়া যাক এই প্রশ্নের উত্তরগুলো।

করপোরেট বুকিং কী?
করপোরেট বুকিংকে এককথায় বলা চলে কৃত্রিম বুকিং। যা প্রকৃত নয়, করপোরেটভাবে তৈরি করা। ধরুন কোনো তারকা একটি ব্র্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হলো এবং তাকে সেই ব্র্যান্ড থেকে পাঁচ কোটি টাকা প্রদানের চুক্তি হলো।

এখন সেই তারকা ৩ কোটি নেবেন এবং তাঁর অথবা বিশেষ কোনো সিনেমার হয়ে সেই ব্র্যান্ডের কর্মীদের জন্য দুই কোটি মূল্যের টিকিট কিনতে উক্ত কম্পানিকে বলবেন। এমনটা করার মাধ্যমে সেই তারকা অনেক বড় অ্যামাউন্টের ট্যাক্স সাশ্রয় করেন।

তাই তিনি ডিস্ট্রিবিউটর শেয়ার করার পরেও তেমন কিছু হারান না এবং তাঁর ব্র্যান্ডের মূল্যও বৃদ্ধি পায়। যার অর্থ দাঁড়ায়, আরো অর্থ। ওদিকে কম্পানি তাদের কর্মীদের টিকিট সরবরাহের মাধ্যমে তাদের সমর্থন ও সদিচ্ছা লাভ করে।

এ ক্ষেত্রে কোনো মার্কেটিংয়েরও প্রয়োজন পড়ে না, তাই কোনো অতিরিক্ত ট্যাক্সও নেই। সেই সঙ্গে এটি সেই কম্পানির কর্মচারীদের জন্য একটি বাড়তি সুবিধা। এসব ক্ষেত্রে প্রযোজকরাও অনেক কম্পানির টিকিটের ব্যয়ভার বহণ করেন বুকিংয়ের মাধ্যমে সিনেমার হাইপ তৈরি করতে। একেই বলে করপোরেট ডিল। যা সিনেমার ক্ষেত্রে করপোরেট বুকিং হিসেবে এখন নতুন ট্রেন্ড হয়ে উঠেছে।

করপোরেট বুকিংয়ের মাধ্যমে একটি সিনেমা মুক্তির আগেই তুমুল হাইপ তৈরি করা হয়। একজন সাধারণ দর্শক যখন কোনো সিনেমার টিকিট বুক বা ক্রয় করেন, তখন সিনেমা হলে শোয়ের টিকিট বিক্রির হার অনেক বড় প্রভাব ফেলে দর্শকমনে। হলের দর্শকসারি খালি দেখালে সেই শোয়ের টিকিট কেনার আগ্রহ অনেকে হারিয়ে ফেলেন।

কিন্তু যখন প্রতিটি শোয়ের টিকিট বিক্রি দেখায়, আসনসংখ্যা ভর্তি থাকে বুকিংয়ে, তখন সাধারণ দর্শক মনে করেন, সিনেমাটি হিট হতে যাচ্ছে। এর টিকিটের চাহিদা রয়েছে। তাই এটি দেখা উচিত। এভাবেই করপোরেট বুকিংয়ের মাধ্যমে দর্শকমনে প্রভাব ফেলা হয়, যা পরবর্তী সময়ে সিনেমার আয়ের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সিনেমা হলে শোগুলোর আসনসংখ্যা ফাঁকা থেকে যায়। এই দৃশ্য এখন নিত্যদিনের বিষয় সিনেমা হলে।

বিগত কয়েক বছর ধরেই করপোরেট বুকিং নিয়ে বেশ সরগরম বলিউড। এ বছর করণ জোহর পরিচালিত ‘রকি অউর রানি কি প্রেম কাহানি’-এর জন্য ৫০ হাজার টিকিট কেনার মধ্য দিয়ে করপোরেট বুকিংয়ের প্রবণতা আবারও সামনে এসেছে। হ্যাঁ, করণ জোহর নতুন করে আরেকবার এই দুশ্চিন্তার অধ্যায় ওপেন করেছেন বলিউডের জন্য! সিনেমাটি মুক্তির সপ্তাহান্তে কাজরিয়া এবং পেপসির মতো ব্র্যান্ডগুলো তাদের গ্রাহকদের বিনা মূল্যে টিকিট দেওয়ার জন্য প্রধান সিনেমা চেইনের সাথে অংশীদারি করেছিল।

এ বছর একই রকম কৌশল অবলম্বন করতে দেখা গেছে প্রভাসের ‘আদিপুরুষ’ এবং কার্তিক আরিয়ানের ‘শেহজাদা’র মতো সিনেমার ক্ষেত্রেও। আদিপুরুষের জন্য রণবীর কাপুর এবং অন্যান্য তারকারা প্রত্যেকে ১০ হাজারটি টিকিট কিনেছিলেন। শেহজাদার ক্ষেত্রে একটি কিনলে একটি ফ্রি টিকিটের অফার দেওয়া হয়েছিল।

বলিউডের বড় তারকাদের বেশির ভাগ চলচ্চিত্র এখন করপোরেট বুকিংয়ের দিকে ঝুঁকছে, যা সিনেমাপ্রেমী ও দর্শকদের জন্য অশনিসংকেত। সাফল্যের একটি মিথ্যা ধারণা তৈরি করতে করপোরেট বুকিং ব্যাপকভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে, কিন্তু কৌশলটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছে। করপোরেট বুকিং স্বভাবতই একটি সিনেমার উদ্বোধনী আয়ের ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব ফেলে।

বিশেষ করে শাহরুখ, সালমান, প্রভাসদের মতো বড় তারকাদের ক্ষেত্রে করপোরেট বুকিং তাদের সিনেমার উদ্বোধনী আয়ে নতুন হাওয়া দেয়, যা সিনেমাটির বক্স অফিসের যাত্রায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। যেমনটা ২০২২ সালে করণ জোহরের ‘ব্রহ্মাস্ত্র’। এই সিনেমাটিও করপোরেট বুকিংয়ের সাহায্য নেয়। প্রথম দিনের আয়ে বক্স অফিসে দারুণ সাফল্য দেখালেও পরবর্তী সময়ে দর্শকদের উপহাস এবং হতাশার মুখে পড়ে এটি। যেমনটা ২০২৩ সালের সবচেয়ে ব্যবসা সফল সিনেমা শাহরুখ খানের পাঠান ও জওয়ানের ক্ষেত্রেও করপোরেট বুকিংয়ের অভিযোগ উঠেছে।

উদ্বোধনী দুর্দান্ত আয় দিয়ে যাত্রা শুরু করে সিনেমা দুটি বক্স অফিসে রেকর্ড গড়তে সক্ষম হয়। এ বছর প্রভাসের ‘আদিপুরুষ’ ও সালমান খানের ‘টাইগার ৩’ সিনেমাটির ক্ষেত্রেও করপোরেট বুকিংয়ের প্রবণতা দেখা গেছে, তবে পরবর্তী সময়ে সিনেমা দুটির প্রতি দর্শকদের অনীহা বক্স অফিসে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। অর্থাৎ করপোরেট বুকিং দিয়ে যতই হাইপ তোলা হোক, সিনেমা দর্শকদের পছন্দ না হলে সেটির বক্স অফিসের কৃত্রিম হাইপ কাজে আসবে না। এটা প্রমাণিত।

চলতি বছর শেষে একসঙ্গে মুক্তি পাওয়া শাহরুখ খানের ডানকি ও প্রভাসের সালারের বক্স অফিস লড়াইয়ের মাঝে ফের উঠে আসে করপোরেট বুকিংয়ের অভিযোগ। প্রশান্ত নীল পরিচালিত ‘সালার’-এর করপোরেট বুকিং সিনেমাটির প্রথম দিনের আয়ে বড় প্রভাব রেখেছে, এমনটাই দাবি করছেন শাহরুখভক্তরা। সিনেমাটির প্রথম চার-পাঁচ দিনের আয়ের ক্ষেত্রে বক্স অফিসের ফিগারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।

অপরদিকে প্রভাসভক্তদের দাবি, ন্যাশনাল চেইনের সঙ্গে মিলে উত্তর ভারতে সালারের শো নামিয়ে ফেলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন শাহরুখ। এসব বিতর্ক তো চলবেই। দিনশেষে দর্শকরা যে সিনেমা পছন্দ করবে, সেটি চলতে থাকবে লম্বা সময় ধরে। করপোরেট বুকিংয়ের হাইপ সেই সিনেমার ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না, এটিই প্রমাণিত সত্য।

কারণ করপোরেট বুকিং সব ক্ষেত্রেই সফল হয় না। দর্শকরা সিনেমার মাঝে নিজেদের পছন্দের উপাদান খুঁজে না পেলে ধীরে ধীরে তা বক্স অফিসে প্রভাব ফেলে। এটাই নিয়ম। করপোরেট বুকিংয়ের ক্ষেত্রে একটি সিনেমার তুমুল হাইপ তৈরি করা হলেও সিনেমা হলে প্রদর্শনের পর দর্শকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এর প্রতি। তাই প্রতিনিয়ত এই করপোরেট বুকিংয়ের প্রবণতা বলিউডকে অন্ধকার এক অধ্যায়ের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। সাধারণ দর্শক ও সিনেমাপ্রেমীদের ক্ষেত্রে যা হয়ে উঠছে আত্মঘাতী।

এ ক্ষেত্রে এখনো বিশ্ববাজারে আদর্শ হিসেবে হলিউডের উদাহরণ দেওয়া যায়। চলতি বছর হলিউডের শীর্ষ আয়কারী চলচ্চিত্র ‘বার্বি’ এবং ‘ওপেনহাইমার’র টিকিট উচ্চদামের হওয়া সত্ত্বেও দুর্দান্ত ব্যবসা করেছে। এ বছর বলিউডের ‘দ্য কেরালা স্টোরি’, ‘সত্যপ্রেম কি কথা’, ‘তু ঝুটি ম্যায় মাক্কার’, ‘ফুখরে ৩’, ‘টুয়েলভথ ফেইল’, ‘শ্যাম বাহাদুর’-এর মতো চলচ্চিত্রগুলোও বক্স অফিসে বেশ ভালো করেছে তাদের ভালো চিত্রনাট্য ও নির্মাণের কারণে। তার মানে দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহে আসতে প্রস্তুত যদি সিনেমার বিষয়বস্তু আকর্ষণীয় হয়।

কিন্তু ভালো এবং বিনোদনমূলক চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিবর্তে, বলিউড নিজে টিকিট কেনার দিকে ঝুঁকছে বা সস্তায় বা এমনকি বিনা মূল্যে টিকিট অফার করছে। এই স্ব-নির্মিত অনুশীলনগুলো দিন দিন মারাত্মক হয়ে উঠছে এবং দীর্ঘমেয়াদে বলিউড শিল্পের অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে যাচ্ছে বলেই ধারণা করছেন বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা। সিনেমার টিকিট ক্রয় করেও দর্শকরা যখন আসতে চায় না, তাতে কিছু যায় আসে না, কারণ তারা আসবে না। এটি চিরাচরিত প্রথা। কিন্তু ফিল্ম হিট হওয়ার মিথ্যা ধারণা তৈরি করার জন্য এই প্রতারণামূলক করপোরেট বুকিংগুলো আত্মঘাতী এবং বলিউডের জন্য ধ্বংসাত্মক হতে চলেছে দিনকে দিন।

তাই পরিশেষে বলাই যায়, করপোরেট বুকিংয়ের এই শুভঙ্করের ফাঁকি থেকে বের হতে না পারলে বলিউডের জন্য সামনে অন্ধকার এক অধ্যায় অপেক্ষা করছে। কারণ দিনশেষে সিনেমা দর্শকদের জন্য। দর্শকদের স্বাভাবিক আগ্রহ, ভালো লাগা, উৎসাহ-উদ্দীপনাই একটি সিনেমার সাফল্য নির্ধারণ করবে। তবেই একটি সিনে ইন্ডাস্ট্রি সঠিক পথে চলবে।-কালের কণ্ঠ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে