বিনোদন ডেস্ক : মাত্র ১২ বছর বয়সে পাকিস্তানের ‘জুগনু’ সিনেমার একটি গানে কণ্ঠ দেওয়ার মাধ্যমে পেশাদার সংগীতশিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু করেন রুনা লায়লা। ওই অল্প বয়সেই তার কণ্ঠে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সংগীতজ্ঞরা। ফলস্বরূপ সিনেমার গানে নিয়মিত হন তিনি। অল্প সময়েই পশ্চিম পাকিস্তানের শ্রোতাপ্রিয় গায়িকায় পরিণত হন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় রুনা লায়লা যখন বাংলাদেশে ফিরে আসেন তখন পাকিস্তানে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করছিলেন তিনি। দেশটির সরকারও তাকে ধরে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। কিন্তু নাড়ির টান পেয়ে বসেছিল তাকে। জনপ্রিয়তা, ক্যারিয়ার, সম্মান—সব তুচ্ছ করে ফিরে আসেন প্রিয় মাতৃভূমিতে।
বাংলাদেশে এসে সংগীতে পথচলাটা তিনি শুরু করেন সংগীত পরিচালক সত্য সাহার হাত ধরে। এরপরের গল্প শুধু জয়ের আর অর্জনের। সে গল্প সবার জানা। ‘দামা দাম মাস্ত কালান্দার’ থেকে শুরু করে ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই’—সর্বত্র সুরের মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেছেন তিনি।
পৃথিবীর এমন কোনো বড় শহর নেই যেখানে রুনা লায়লা তার সুরের দ্বীপ জ্বালাননি। বাংলা, উর্দু, হিন্দিসহ ১৮টি ভাষায় ১০ হাজারেরও বেশি গান করেছেন তিনি। তার গান শুনে ঘোর সমালোচকও হয়ে গেছেন তার ভক্ত। এমন একটি ঘটনা ভারতে ঘটেছিল। তৎকালীন ভারতের ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক খুশবন্ত সিং ছিলেন রুনা লায়লার ঘোর সমালোচক।
সমালোচনা করতে মুখিয়ে থাকতেন তিনি। এই উদ্দেশ্যেই একবার গিয়েছিলেন রুনা লায়লার গান শুনতে।
সম্পাদক মহাশয় সেদিন রুনা লায়লার গান ও নাচে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে পরদিন তার কাগজ ভরিয়ে দেন রুনা লায়লার স্তুতিবাক্যে। তিনি লিখেছিলেন, ‘রুনাকে দিয়ে দাও, বিনিময়ে ফারাক্কার সব পানি নিয়ে যাও।’
শুধু তাই নয় কাশ্মীরের মানুষ এখনো রুনা লায়লাকে দোয়া করেন। কেননা কাশ্মীরের হাসপাতালের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রুনা লায়লার নাম।
রুনা লায়লা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, খুশবন্ত সিং ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক ছিলেন। তিনি কিন্তু খুব কম সময়ই প্রশংসা করতেন। সব সময় সমালোচনা করতেন। কিন্তু একবার আমার একটা কনসার্টে এসেছিলেন—সম্ভবত দিল্লিতে। পুরো অনুষ্ঠানে ছিলেন। কোনো মন্তব্য করলেন না। আমার সঙ্গে দেখাও করেননি; কোনো কথাও বলেননি। কিন্তু তাঁর পত্রিকায় আমাকে নিয়ে অনেক কিছু লিখেছিলেন। এর মধ্যে ছিল, রুনা লায়লার গান শুধু শোনারই বিষয় না, দেখারও ব্যাপার আছে। তার পুরো অনুষ্ঠানটি দেখেছি। আমি শুধু একটা কথাই বলব বাংলাদেশ সরকারকে, ‘প্লিজ গিভ আস রুনা লায়লা, অ্যান্ড টেক অল দ্য ওয়াটার অব ফারাক্কা।’
কাশ্মীরের প্রসঙ্গে রুনা লায়লা বলেন, শেখ আবদুল্লাহ ওই সময় কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাঁকে নিয়েও বড় একটা ঘটনা আছে। সম্ভবত ১৯৭৭ বা ১৯৭৮ সাল হবে। তখন শ্রীনগরে কোনো হাসপাতাল ছিল না। চিকিৎসা করতে চণ্ডীগড় বা দিল্লিতে যেতে হতো। তিনি একবার নিজের হাতে আমাকে চিঠি লিখলেন, ‘শ্রীনগরে একটা হাসপাতালের জন্য তহবিল গঠন করতে চাই। আপনি একটা গানের অনুষ্ঠান করে দেবেন? আপনার যা পারিশ্রমিক, তা আমাকে জানিয়ে দেবেন—আমি সেভাবে আয়োজন করব।’
রুনা লায়লা বললেন, আমি উত্তরে লিখলাম, ‘আপনি এত বড় একজন মানুষ হয়ে আমাকে আমন্ত্রণ করেছেন এত ভালো একটা কাজের জন্য, এটা আমার জন্য অনেক আনন্দের। আমি কোনো পারিশ্রমিক নেব না। কোনো পেমেন্টের প্রশ্নই আসে না। আমি আসব আর বেরিয়ে যাব—আপনার হাসপাতালের জন্য অনুষ্ঠানে গান করব।’ তিনি আরেকটা চিঠিতে লিখলেন, ‘ইউ অ্যান্ড ইওর হোল ফ্যামিলি আর করডিয়েলি ইনভাইটেড টু কাম অ্যাজ মাই গেস্ট।’ সেই চিঠিতেই তিনি আরো লিখেছিলেন, ‘এখানকার অনেক শিল্পীকে আমি বলেছি, কেউ পারিশ্রমিক ছাড়া অনুষ্ঠান করতে রাজি হননি। আপনি অন্য দেশের শিল্পী হয়ে আমার দেশের মানুষের জন্য তহবিল গঠনে গান করতে রাজি হয়েছেন—বিনা পারিশ্রমিকে গান করবেন। আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ আপনার কাছে।’ এরপর মা-বাবাসহ আমরা সবাই গেলাম। বিমান থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের লাল গালিচা অভ্যর্থনা জানালেন এবং তাঁর অতিথিশালায় আমাদের রাখলেন। তাঁর ছেলে ফারুক আবদুল্লাহ বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে দেখালেন। আমাদের সবাইকে অনেক কিছু উপহার দিলেন।
কিংবদন্তি এই সংগীতশিল্পী বললেন, সেখানে দুই দিন অনুষ্ঠান করলাম। প্রথম দিনের অনুষ্ঠান হলো একটা মিলনায়তনে। সেই মঞ্চে এত সুন্দর করে আমার সম্পর্কে তিনি বললেন, কখনোই চিন্তা করতে পারি না, একজন মানুষ সম্পর্কে কিভাবে এত ভালো করে বলা যায়। দ্বিতীয় দিন অনুষ্ঠান হলো স্টেডিয়ামে। সেখানে অনেক লোকসমাগম হলো। ওই অনুষ্ঠান এবং আমার নিরাপত্তার জন্য সেখানে চৌদ্দ শ মাউন্টেইন পুলিশ নিয়োজিত ছিল। এখনো কলকাতায় যারা কাশ্মীরি শাল বিক্রি করে, তাদের কেউ কেউ আমাকে দেখে বলে, ‘আপনাকে আমরা অনেক দোয়া দিই।’ কেন, কী হলো? তারা বলে, ‘আপনি যে আমাদের জন্য হাসপাতাল করে দিয়েছেন। আপনার নামটা সেই হাসপাতালে লেখা আছে। আমরা যখনই সেখানে যাই, খুব দোয়া দিই।’ আমি মনে করি, এটা একটা বিরাট পাওয়া।
আজ ১৭ নভেম্বর রুনা লায়লার জন্মদিন।