বিনোদন ডেস্ক : ইদানীং এ ধরনের লিফ্ট বড় একটা দেখা যায় না। প্রথমে কাঠের দরজা, তারপর লিফ্টের কোল্যাপসিবল গেট। পৌঁছনো গেল পাঁচতলায়।
‘‘বাসা চিনতে অসুবিধা হয়নি তো !’’
ঢাকাই বাঙাল এরপর নাগাড়ে যত কথা বলবেন, তার পরতে পরতে পূর্ববঙ্গীয় আতিথেয়তা, লাবণ্য আর উর্দু শব্দের প্রভাব।
সদর দরজা নিজেই খুললেন অভিনেত্রী। কলকাতার বাসায় একাই থাকেন। বসার ঘরে দেওয়াল জোড়া কাঠের ক্যাবিনেট খাঁ খাঁ করছে। সম্ভবত সদ্য তৈরি। জিনিস রাখা হয়নি। ছিমছাম ঘরের অন্যপ্রান্তে খাওয়ার টেবিল। বাহারি জলের বোতল আর টুকিটাকি জিনিসপত্র রাখা।
নিতান্তই মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাট। অভিনেতার ফ্ল্যাট নয়। আতিশয্য নেই। বিলাস নেই। এমনকী, তাঁর কোনও ছবিও নেই।
খোলা চুল ঘাড়ের একপাশে টানতে টানতে সোফায় বসলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম অভিনেত্রী। বলছেন ‘মুল্কে’র কথা।
দেশ নিয়ে কথা বলার সময় তিনি সচেতন। কিন্তু অতিরিক্ত সাবধানি নন। পছন্দ-অপছন্দ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে ‘কসুর’ করেন না। আবার ‘ইন্ডিয়া’ নিয়ে কথা বলার সময়েও কোনও ভণিতা করেন না তিনি। ভাল-মন্দ সাদা-কালোয় বলতেই পছন্দ করেন। এ দেশের মানুষ, বন্ধু, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, এমনকী, উগ্র জাতীয়তাবাদ বিষয়েও তাঁর স্পষ্ট মতামত আছে।
জয়া আহ্সান আর পাঁচজন অভিনেত্রীর মতো নন। প্লাস্টিক হাসিতে বিতর্ক এড়িয়ে চলেন না। একান্ত আড্ডায় পোশাক এবং মেক-আপেও কোনও বাড়াবাড়ি নেই। সাধারণ সালোয়ার কামিজ পরিহিতা নির্ভেজাল আড্ডায় একবারের জন্যেও নিজের অভিনেতা-সত্তাটি প্রকাশ করেননি।
জয়া বলছেন, শ্যুটিংয়ের সময় ভ্যানিটি ভ্যানে রং মেখে বসে থাকতে তিনি পছন্দ করেন না। তিনি জীবন দেখতে ভালবাসেন। তাই শট না-থাকলেও ঢাকুরিয়া ব্রিজে শ্যুটিংয়ের সময় তিনি ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকেন। ব্রিজের নীচের বস্তির দিকে তাকিয়ে থাকেন। ঝুপড়িবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর ইচ্ছে করে। বুঝতে ইচ্ছে করে তাঁদের যাপনকথা, বাচনভঙ্গি, দৈনন্দিন সমস্যা। সমস্যার সঙ্গে জুঝে চলার শরীরী ভঙ্গিমা।
জয়ার মতে, অভিনেতা যদি মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান, তা হলে সেখানেই তাঁর অভিনয়-জীবন থমকে যায়। কিছু আরোপিত ‘ম্যানারিজম’ থেকে যায় কেবল। তাঁর মতে, অভিনয় উঠে আসে সমাজ থেকে। যে মুহূর্তে গাড়ির ‘টিন্টেড গ্লাস’ সমাজের সঙ্গে অভিনেতার ব্যবধান তৈরি করে দেয়, অভিনেতার মৃত্যুর শুরু হয় সেখান থেকে। গাড়ির নিরাপদ ঠান্ডায় বসে অভিনেতা আর তখন বাইরের তাপমাত্রা টের পান না।
জয়া বেরিয়ে পড়েন। কলকাতা তাঁর খুব ভাল চেনা নয়। তাই এখানে খুব একটা ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পান না। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় যখন-তখন বেরিয়ে পড়ার অভ্যাস তাঁর আছে। রিকশ-অটো হরদম চড়েন। ঘুরে বেড়ান শহর। সাধারণ পোশাক আর মেক-আপহীন চেহারায় অভিনেত্রীকে কেউ চিনতেও পারেন না। পাঁচজনের সঙ্গে মিশে যান জয়া। ওটাই তাঁর অভিনয়ের ওয়ার্কশপ। তালিম নেওয়া গাইয়ে, দক্ষ চিত্রকর কখনও অভিনয় শেখেননি। নিজেই নিজের অভিনয়ের শিক্ষক হয়ে উঠেছেন।
গান আর ছবি নিয়ে অবশ্য খুব বেশি কথা বলতে চান না জয়া। বলেন, শ্যুটিংয়ের চাপে বাকি চর্চা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আপেল আঁকতে গেলে এখন পেয়ারার মতো দেখতে হয়ে যায়। যেটা বললেন না, ঢাকার বিখ্যাত প্রদর্শশালায় তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়েছে।
জয়ার ঠোঁটে লাজুক হাসি। ফিরলেন অভিনয় প্রসঙ্গে। তাঁর আক্ষেপ, নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার মতো কাজ পাচ্ছেন না। অধিকাংশ ছবিতেই ‘টাইপড কাস্ট’ করা হচ্ছে তাঁকে। সকলেই ছবিতে জয়া আহ্সানকে চাইছেন। ফলে নতুন নতুন চরিত্র করার সুযোগ মিলছে না। অভিনেত্রী ভেবেছিলেন, কলকাতায় নতুন কাজের সুযোগ পাবেন। কিন্তু দু’একটা ছবি ছাড়া মনের মতো চরিত্র এখনও পাননি। যে চরিত্র রাতের ঘুম কেড়ে নিতে পারে।
আরও অনেকের মতো জয়াও বলছেন, পশ্চিমবঙ্গের ইন্ডাস্ট্রি মধ্যবিত্ততায় আটকে গিয়েছে। বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রি নিয়েও খানিক হতাশ তিনি। তাঁর মতে, দশ বছর আগে এপার-বাংলার যা অবস্থা ছিল, বাংলাদেশের ছবি এখন সেই স্তরে আটকে। দারুণ দারুণ ভাবনা নিয়ে নতুন নতুন ছেলেমেয়েরা ছবি করতে চাইছেন, কিন্তু টাকা পাচ্ছেন না। যাঁরা সুযোগ পাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই উচ্চতায় পৌঁছতে পারছেন না। তবুও জয়া আশাবাদী।
বলছেন— চাকা ঘুরছে। দু’দেশেই সম্ভাবনাময় ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ পরিচালক তৈরি হচ্ছেন। ছবির চরিত্র বদলে দিতে পারবেন তাঁরা। যেমন হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। ইরানি ছবির ভক্ত জয়া বলছেন, লড়াই থেকেই ছবির গল্প তৈরি হয়। ইরানে হচ্ছে। এখানেও নিশ্চয়ই হবে।
লড়াই তো জয়ার চেতনায় ! বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। বড় হয়েছেন যুদ্ধের গল্প শুনে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি ‘গেরিলা’ ছবিতে সকলকে চমকে দিয়েছিলেন তিনি। ছবিতে একের পর এক মুক্তিযোদ্ধার লাশের মাঝখান দিয়ে হাঁটার সময় ছলছল করছিল তাঁর চোখ।
ছলছল করছে চোখ। জয়া বলছেন, তাঁর বাবার কথা। ‘‘বাবার তো বেঁচে থাকারই কথা ছিল না। খানসেনা ধরে ফেলেছিল। হাত বেঁধে ব্রিজের উপর দাঁড় করিয়ে গুলি করা হচ্ছিল সকলকে। শেষমুহূর্তে বাবা ঝাঁপ দিয়েছিলেন নদীতে। ইনশাল্লাহ !
বেঁচে গিয়েছিলেন।’’
এতক্ষণে অভিনেত্রীকে চেনা গেল। নিখুঁত দক্ষতায় চোখ মুছতে মুছতে উঠে পড়লেন জয়া। কান্না ঢাকতে প্রশ্ন করলেন— ‘‘কী খাবেন বলেন? চায়ে মিষ্টি চলে তো? সঙ্গে একটু সন্দেশ আর ভুজিয়া দেই?’’
বলা গেল, শুধু চা। জয়া নাছোড়। বাঙালের বাড়িতে শুধু চা দেওয়া যায় নাকি? শেষপর্যন্ত রফা হল ঢাকায় তাঁর বাড়ি গিয়ে ভূরিভোজ করতে হবে। কলকাতার বাসায় শুধুই আর্ল গ্রে।
টেবিলের উপর আইফোন আর আইপড। প্রায় ১১ হাজার গান আছে জয়ার আইপডে। রবীন্দ্রসংগীত থেকে মেটাল, রক— সব রকম। তবে তিনি বাউলভক্ত। সাংবাদিকেরও বাউলগানে আগ্রহ আছে শুনে সরাসরি আমন্ত্রণ জানালেন ফরিদপুরে। সেখানকার বাউল-ঠেকে নিয়মিত যাতায়াত আছে তাঁর। বাউলসঙ্গে তাঁর প্রবল টান। ভালবাসেন ‘বোহেমিয়ান’ জীবনযাপন। ফিল্মি পার্টি আর রগরগে গসিপে তাঁর ঘোর অরুচি।
কলকাতার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি অবশ্য গসিপেই আছে। জোর খবর, ‘বোহেমিয়ান’ জয়া নাকি সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছেন। কিছুদিন আগেই এক সাক্ষাৎকারে জয়া বলেছিলেন, ওসব শুনলে তাঁর হাসি পায়। এবার আর হাসলেন না। বললেন, কলকাতায় গসিপ বোধ হয় একটু বেশিই চলে। তিনি বিরক্ত। গুজব নিয়ে কোনও আলোচনাই করতে চান না।
তবে পরিচালক সৃজিতকে তিনি পছন্দই করেন। যেমন পছন্দ করেন আরও অনেককেই। অরিন্দম শীলের কাছে তিনি কৃতজ্ঞ। কলকাতায় অভিনয় করার প্রথম সুযোগ অরিন্দমই করে দিয়েছিলেন। কৃতজ্ঞ ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর প্রতিও। তাঁরই একটি শর্ট ফিল্মে আপাতত অভিনয় করছেন জয়া। ইন্দ্রনীলের কাজ খুবই পছন্দ তাঁর। সৃজিতের ‘রাজকাহিনি’র স্ক্রিপ্ট নিয়েও খুব উত্তেজিত ছিলেন অভিনেত্রী। তবে ছবিটা দেখে ততটা খুশি হননি। বলছেন, আরও অনেক ভাল হতে পারত। অনেক ভাল জায়গা সৃজিত নাকি ফেলে দিয়েছেন। ‘রাজকাহিনি’র প্রসঙ্গেই উঠে এল জয়ার মুখে সাহসী সংলাপের কথা। অভিনেত্রী বলছেন, ওই সব সংলাপের অধিকাংশই তিনি নিজে লিখেছেন। সৃজিতের বাঙাল সংলাপ তাঁর পছন্দ হচ্ছিল না।
কলকাতার ভাষা আয়ত্ত করতে তাঁর অসুবিধা হয়? জয়া হাসছেন। অসুবিধা হয়। কলকাতার সিনেমাজগতে ইদানীং যে ভাষাটা ব্যবহার হয়, সেটার সঙ্গে একেবারেই পরিচিত নন তিনি। খুব ‘মেকি’ লাগে। বরং উত্তম-সুচিত্রার ছবির বাংলা অনেক বেশি স্বাভাবিক বলে মনে হয় তাঁর। সেই বাংলার সঙ্গে বাংলাদেশের শহুরে বাংলার অনেক মিল। জয়ার আক্ষেপ, বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মও ‘বাংরেজি’ রপ্ত করছে। তাতে নষ্ট হচ্ছে বাংলাভাষার মাধুর্য।
সোফা থেকে চেয়ারে গেলেন জয়া। তিনি মানছেন, যে বাংলাদেশের স্বপ্ন মুক্তিযোদ্ধারা দেখেছিলেন, সেই বাংলাদেশ তৈরি হয়নি। উগ্রতা গ্রাস করছে সমাজকে। এক শ্রেণির মানুষ দেশের যুবসমাজের মগজধোলাই করছে। দোষটা যুবসমাজের নয়, ওই মানুষগুলোর। ঠিক পথে চালিত হলে তারাই ‘শাহবাগ’ ঘটিয়ে ফেলতে পারে। শাহবাগের বাংলাদেশ জয়ার বাংলাদেশ। মৌলবাদী বাংলাদেশ নয়।
স্বাভাবিকভাবেই জয়ার এসব কথা উগ্রবাদীরা পছন্দ করে না। দেশে বহু সমালোচনা সহ্য করতে হয় তাঁকে। কিন্তু ওই যে, রাখ-ঢাক করে কথা বলতে পারেন না তিনি ! অভিনয় করতে পারেন না ! সবকিছুকে ভালও বলতে পারেন না। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার শিক্ষাটা বাবার কাছে পেয়েছিলেন তিনি। আর পেয়েছেন ছোটবেলার হস্টেলে। হস্টেলই তাঁকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিয়েছে।
লিফ্টের কাঠের দরজা খুলে দিলেন অভিনেত্রী। কোল্যাপসিবল গেট লাগানোর মুহূর্তে আচমকা বাধা দিলেন— ‘‘একটা কথা বলা হল না। নামের বানানটা ঠিক লিখবেন, প্লিজ। এহসান নয়, আহ্সান। সকলেই ভুল লিখছেন।’’-এবেলা
১০ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমএন