মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : ফিল্মমেকারের কাজ মন বোঝা। ছেলের মন বোঝা, মেয়ের মন বোঝা, এমনকি তৃতীয় লিঙ্গের মনও বোঝা। শাসকের মন বোঝা, শাসিতেরও মন বোঝা। এক ধরনের মনের ডাক্তারি নিয়ে আছি আর কি আমরা। তো এটা করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে জাতির মনটাও একটু বোঝার চেষ্টা করি।
আজকে ঈদের ছুটি উপলক্ষে বিশেষ লেখায় আসুন আমরা জাতির মনে ডুব দিয়ে একটু থই খুঁজি। আমাদের নবীন রাষ্ট্রের কাঁচা মন এখনো একটা তুমুল ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটাকে নির্মাণাধীন মন-ভবন বলা যেতে পারে। এমনই সময় এসব বিষয় নিয়ে বেশি বেশি কথা বলা যাতে এসব জিজ্ঞাসা আমাদের আত্মোপলব্ধি এবং মোটামুটি এক ধরনের মীমাংসার দিকে নিয়ে যায়। বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ তার আত্মগরিমা। এই জাতির গরিমায় আঘাত দিয়ে কেউ পার পায়নি। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা এই জাতিকে যতটা গরিমা দিয়ে গড়েছেন, তার অর্ধেকও আত্মবিশ্বাস যদি দিতেন!
অবশ্যই ব্যক্তিপর্যায়ে আমরা অনেক আত্মবিশ্বাসী মানুষের গল্প জানি, কিন্তু গড় আলাপে গেলে দেখি আমাদের অনেকের মনেই আত্মবিশ্বাসের বড় অভাব। নিজের পোশাক নিয়ে আত্মবিশ্বাসের অভাব, নিজের মতো করে সাহিত্য করতে আত্মবিশ্বাসের অভাব, নিজের মতো করে ছবি বানাতে আত্মবিশ্বাসের অভাব, নিজেদের পণ্য উৎপাদন কিংবা ব্যবহারে আত্মবিশ্বাসের অভাব। এসব অভাব নিয়ে আমাদের অনেকেই একরকম সংকুচিত হয়ে থাকেন। আর এই সংকোচ থেকেই তৈরি হয় ‘আমাদের নকলনবিশ’ মন।
আলোচনার আরেকটু গভীরে ঢোকার আগে এখানে বলে রাখা ভালো, যে অভাবের গল্প এখানে বলছি এটা যে শতভাগ বাঙালিই আক্রান্ত-ঘটনা তা নয়। বরং আগের তুলনায় এখনকার পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। বাঙালির তরুণ মনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ‘আপনারে’ নিয়া অহেতু সংকোচমালায় ভোগে না। তারা বাংলাদেশি ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর বানানো পোশাক গর্বের সঙ্গে পরে, বলিউড স্কুলের নয় এমন ছবি দেখতেও দলে দলে থিয়েটারে যায়।ডিসক্লেইমার শেষ। এবার ফিরে আসি মূল আলোচনায়।
কথা হচ্ছিল আমাদের কারও কারও নকলনবিশ মন নিয়ে।শুরুটা করি পোশাক দিয়ে। পুরুষের পোশাক হিসেবে এ দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘লুঙ্গি’। লুঙ্গিই একমাত্র পোশাক যেটা আমাদের জাতীয় পোশাকের মতো কিছু একটা হতে পারত। কিন্তু যেহেতু আমাদের নিজেদের জিনিস নিয়ে আমাদের সংকোচের শেষ নেই, সেহেতু এটা পরিণত হলো ‘ইজ্জত হানিকর’ পোশাক হিসেবে।
কেরালার লোক তার ট্রাডিশনাল লুঙ্গি পরে মঞ্চে বক্তৃতা দেওয়াকে গৌরবের মনে করে, সৌদি আরবের লোক তার ট্রাডিশনাল পোশাকে কোনো অগৌরব খুঁজে পায় না, চীনের লোক কোনো অগৌরব খুঁজে পায় না, ইংলিশরা খুঁজে পায় না, মিয়ানমারের লোক খুঁজে পায় না, সব অগৌরব এসে ভর করল আমাদের কাঁধে? আমি বলছি না এখন ‘লুঙ্গি’ বিপ্লবের মাধ্যমেই আমাদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার সূচনা হোক।
আমি শুধু ইঙ্গিত করছি আমাদের অনেকের মনের ভিতর কীভাবে বছরের পর বছর আত্মবিশ্বাসহীনতার ভাইরাস বিস্তার লাভ করেছে সেটার দিকে। আমরা যখন সাহিত্য করতে গেছি তখন বেশির ভাগই কলকাতার সাহিত্যিকদের স্বর ও সুর নকল করেছি। বলছি না, আমাদের মৌলিক স্বর ও সুরের সাহিত্যিক ছিল না। অবশ্যই ছিল এবং আছে। কিন্তু গড় জোয়ারটা ছিল কলকাতার বড় সাহিত্যিকরা কে কী ঢঙে লেখে সেটা অনুসরণ করার দিকে।
তবে এই ‘নকলনবিশতা’ কেবল বাংলাদেশের বাঙালিদের একক সম্পদ নয়, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যেও সেটা বিদ্যমান আছে বলেই মনে হয়। না হলে এক রবীন্দ্রনাথ এবং এক সত্যজিৎকে এত শত-কোটিবার ফটোকপি কীভাবে করা হয়। যাই হোক, আমার লেখার বিষয়বস্তু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি নয়, বাংলাদেশের বাঙালি। আমাদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট এতটাই আলাদা যে, দুই দেশের বাঙালিদের নিয়ে একই পৃষ্ঠায় আলোচনা চলতে পারে না। তবে একটা ক্ষেত্রে দুই দেশের জন্যই বিশ্লেষণটা সমানভাবে প্রযোজ্য। সেটা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ।
আমি নিজে রবীন্দ্রনাথের গুণমুগ্ধ। তার গান আমাকে আবিষ্ট করে অন্য আরও ভালো গানের মতোই। কিন্তু একটা প্রশ্ন আমার মাথায় বহুদিন ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে। আশা করি প্রশ্নটা কারও কাছে ব্লাসফেমাস হবে না। এই যে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আমরা দলে দলে রবীন্দ্রসংগীত কিংবা নজরুলের গান শিখতে যেতে দেখি, এ রকম নজির কি আর কোনো সংস্কৃতিতে আছে? মানে এটা আমার কৌতূহল আর কি! আমি বলছি না রবীন্দ্র-নজরুল পাঠ করতে হবে না।
অবশ্যই সব ধ্রুপদ সম্পদের ওপর আমাদের জ্ঞান থাকতে হবে এবং সেখান থেকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে। আমি কেবল বোঝার চেষ্টা করছি এই ফেনোমেনার পেছনে আমাদের মন্তব্যটা কী? হাজারে হাজার ছেলেমেয়ে একটা জীবন পার করে দিচ্ছে শুধু রবীন্দ্রনাথের গান বা নজরুলের গান গেয়ে। তাদের নিজেদের কোনো গান নেই, নিজেদের কোনো সুর নেই, রবীন্দ্রনাথের দুঃখই তাদের দুঃখ, নজরুলের সুখই তাদের সুখ। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বাণী ‘শেষ মৌলিক গ্রন্থের’ মতো তাদেরও বাণী।
এই ফেনোমেনা কি অন্য দেশে, অন্য ভাষায়, অন্য সংস্কৃতিতেও আছে? এই ফেনোমেনার মধ্যে কি আমাদের নকলনবিশ মনের কোনো ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে? এ রকম হলে কেমন হতো যদি হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে প্রত্যেকে একটা করে হলেও নিজের গান নিজে লিখছে, নিজের সুর নিজে করছে। আহা আমাদের ধরণী আরও কত সংগীতমুখর হয়ে উঠত! রবীন্দ্রনাথ-নজরুলও কতই না খুশি হতেন।ফিরে আসি বাংলাদেশে। এবং আমি যেহেতু সিনেমা বানাই, ফিরে আসি সিনেমায়।
আপনি যদি নিয়মিত ফেসবুক ব্যবহারকারী হন তাহলে দেখবেন মাঝেমধ্যেই কেউ কেউ বাংলাদেশে বানানো এক ধরনের সিনেমার ট্রেইলার শেয়ার দিয়ে লেখেন ‘ওয়াও, অসাধারণ। কেউ বলতে পারবেন না এটা বাংলাদেশে বানানো সিনেমা। এগিয়ে যাও বাংলা ছবি।’ তারপর ট্রেইলারটা প্লে করলে দেখবেন সেটা পুরনো বলিউড আর হালের তামিল-তেলেগু মাসালা ছবির অন্ধ অনুকরণ। অর্থাৎ তামিল-তেলেগু বা বলিউডের সার্থক নকল ওই মন্তব্যকারীকে আশ্বস্ত করেছে এবং এই অন্ধ অনুকরণের মধ্যেই সে বাংলা ছবির এগিয়ে যাওয়ার রোডম্যাপ খুঁজে পেয়েছে।
বাচ্চালোগ, তালিয়া বাজাও। আরেক দল আছেন যারা ছবির মধ্যে ষাট-সত্তর দশকের কলকাতা আর্ট হাউসের ভঙ্গি খোঁজেন। নিঃসন্দেহে ওই সময়টা বাংলা ছবির ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখনকার চলচ্চিত্রকার কেন সে সময়টা পুনরুৎপাদনের দায় বহন করবেন? এই দলের বোদ্ধারা আবার সেই গন্ধ না পেলে সেটাকে যথেষ্ট সিনেমা মনে করতে পারেন না। নিজের মতো করে নিজের কনটেন্ট নিয়ে কাজ করে নিজের ঢং তৈরি করা যে শিল্পীর আসল কাজ, কলকাতা, ইরান-তুরানের ফটোকপি করা যে শিল্পীর কাজ নয়, তা এই নকলনবিশ মন বুঝতে চায় না।
আশার কথা, এই বদ্ধমূল ধারণাটা আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে। ঝুঁকিটা চলছে বহু বছর ধরে। আরও কিছুকাল এ ঝুঁকি অব্যাহত থাকলে একসময় এর জীর্ণ আস্তর খসে পড়ে যাবে। পরিশেষে অন্যকে দেখে অনুপ্রাণিত হওয়া মানুষের সহজাত প্রবণতার মধ্যেই পড়ে। কখনো জান্তে, কখনো অজান্তে মানুষের মন ‘অন্যের মতো হতে চাওয়ার’ এই ফাঁদে পড়ে। তা ছাড়া এ জটিল ও যৌগিক দুনিয়ায় শতভাগ মৌলিক মন খুঁজতে চাওয়ার মতো নির্বুদ্ধিতা আর দ্বিতীয়টা নেই।
কিন্তু এ অনুপ্রেরণা যখন ফটোকপিতে পর্যবসিত হয় তখন মুশকিল। এ প্রবণতা যখন নিজের গানে নিজের সুরে গাইতে, নিজের পোশাক মাথা উঁচু করে পরতে, নিজের মতো করে ছবি বানাতে মনকে বাধা দেয় বা সংকোচে ভোগায় তখন বুঝতে হবে এটা আর স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই। মনের নব্বই ভাগ যখন এ ভাইরাসে জর্জরিত তখন বুঝতে হবে, আপনার মন হীনমন্যটাইটিসে আক্রান্ত। এটা থেকে বেরিয়ে আসা আশু প্রয়োজন। - বাংলাদেশ প্রতিদিন
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি