বুধবার, ০২ নভেম্বর, ২০১৬, ০১:৪২:২৪

সেদিন কী হয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে

সেদিন কী হয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে

ব্রাহ্মণবাড়িয়া : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ২৮ অক্টোবর সকাল ৯টায় দেখা গেল পবিত্র কাবা শরিফের ছবি। সেখানে কাবা ঘরের উপরের আসনে বসে থাকা মহাদেব মূর্তি। রসরাজ দাস নামে এক ব্যক্তি ছবিটি পোস্ট করেন তার নিজের আইডি থেকে। দেখা যায়, তার কয়েকজন সহকর্মী সেখানে ‘লাইক’ও দিয়েছেন।

কিছুক্ষণের মধ্যে ব্যাপারটি জানাজানি হয়ে গেলে পুরো নাসিরনগরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রসরাজকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। অন্যদিকে দুটি সংগঠনের স্থানীয় শাখা- হেফাজতে ইসলাম ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত ২৯ অক্টোবর প্রতিবাদ সমাবেশ ডাকে। ওই দিন বিক্ষুব্ধরা মিছিল করে। মিছিল উপজেলার প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। মিছিলকারীরা রসরাজের ফাঁসি দাবি করে। দুই সংগঠনে পৃথক পৃথক সমাবেশে কয়েক হাজার লোক অংশ নেয়।

সমাবেশে বক্তারা কাবা শরিফ অবমাননাকারী রসরাজের ফাঁসির দাবি জানায়। বিক্ষোভ মিছিল চলাকালে একদল যুবক উপজেলা সদরের নমশূদ্রপাড়া, কাশীপাড়া, মালিপাড়া ও ঘোষপাড়ায় হামলা চালিয়ে গৌড় মন্দির, শিব মন্দির, দুর্গা মন্দির, রাধাকৃষ্ণ চান্দি মন্দির, মহাদেব মন্দির, দুর্গা মন্দির এবং কাশীপাড়ার শ্যাম সংঘ মন্দিরের ১৫টি প্রতিমা ভাঙচুর করে। এ সময় কমপক্ষে ৩০-৩৫টি বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় হামলাকারীরা। হামলায় গৌড় মন্দিরের পূজারি শংকর সন দাস (ব্রহ্মচারী), গোবিন্দ ঘোষ, তার স্ত্রী, ছেলে সৈকতসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়।

আহত গৌড় মন্দিরের পূজারি শংকর সন দাস (ব্রহ্মচারী)-কে নাসিরনগর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। খবর পেয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক মো. রেজওয়ানুর রহমান, বিজিবির ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মাশরুর উল্লাহ, ১২ বিজিবির অধিনায়ক কর্নেল শাহ আলী, পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান পিপিএম, র‍্যাব ভৈরব ক্যাম্পের স্কোয়াড কমান্ডার এএসপি আবু সাঈদ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) চৌধুরী মোয়াজ্জেম আহমদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর সার্কেল সিনিয়র পুলিশ সুপার মো. আবদুল করিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

তদন্ত কমিটি : নাসিরনগরে মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় আরিফ (২০) নামে এক যুবককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ নিয়ে ৯ জনকে গ্রেফতার করা হলো। হামলাকারীদের গ্রেফতারে ব্যাপক অভিযান চলছে। কাবা শরিফ অবমাননার প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত সহিংস ঘটনা তদন্তে পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে ৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান হলেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি শাখাওয়াত হোসেন। ৭ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটি রিপোর্ট দেবে। পুলিশ সুপার কার্যালয়ে গতকাল বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে সৃষ্ট পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তোলার কাজে সবার সহযোগিতা কামনা করা হয়। জেলা প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত ১২টি মন্দিরকে আর্থিক অনুদান দিয়েছে। গতকাল এ অনুদান নাসিরনগরে গিয়ে দিয়েছেন জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান।

আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীমের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গতকাল নাসিরনগরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। এই দলে ছিলেন আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, কেন্দ্রীয় সদস্য মারুফা আক্তার পপি, গোলাম কবির রব্বানী চিনু, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি মঈন উদ্দিন মঈন প্রমুখ। এ সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা।

শাস্তি দাবি  : নাসিরনগরে পবিত্র কাবা শরিফ অবমাননাকারীর শাস্তি দাবি করেছে আখাউড়ার উলামায়ে কেরাম, ইমাম পরিষদ। গতকাল সকালে আখাউড়া প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। এ সময় আলেমরা নাসিরনগরে হিন্দু মন্দির ও বাড়িঘরে হামলারও নিন্দা জানান। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ইমাম পরিষদ সভাপতি মাও. কাজী মাঈনুদ্দিন বলেন, পবিত্র কাবা শরিফের অবমাননা করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে মারাত্মক আঘাত করেছে রসরাজ দাস। এতে হিন্দু-মুসলিমদের সৌহার্দপূর্ণ অবস্থান ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আলেমরা রসরাজ দাসের সর্বোচ্চ শাস্তি ও ধর্মের অবমাননাকারী নাস্তিক-মুরতাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আইন করার দাবি জানান। তারা বলেন, আমরা বিশৃঙ্খলা চাই না। তাই সংবাদ সম্মেলন করে দাবি জানাচ্ছি। এতে উপস্থিত ছিলেন মাও. মুফতি আসাদুজ্জামান, মাও. ওবায়দুল্লাহ, মাও. হাবিবুল্লাহ সিদ্দিকী, মাও. মহিউদ্দিন সিদ্দিকী, মো. বিল্লাল হোসেন প্রমুখ।

ধর্মের নামে অরাজকতা প্রশ্রয় দেবে না আওয়ামী লীগ : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, আমরা প্রত্যেক ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কারও ধর্ম নিয়ে আমরা কটাক্ষ সহ্য করব না। মিথ্যাচার করে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে অন্য ধর্মের প্রতি আঘাত করা আমরা কখনোই বরদাশত করব না। ধর্মের নামে কোনো প্রকার অরাজকতা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অতীতেও প্রশ্রয় দেয়নি ভবিষ্যতেও দেবে না।

গতকাল দুপুরে আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তব্যের অবহেলার অভিযোগে উঠেছে এ বিষয়ে সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে হানিফ বলেন, নাসিরনগরের ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটল এবং কাদের কর্তব্যের অবহেলার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে তা তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তে প্রমাণিত হলে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আওয়ামী লীগ নাসিরনগরের ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াবে জানিয়ে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হানিফ বলেন, এ জন্য আজ আমাদের একটি প্রতিনিধি দল ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে গেছে। তাদের ক্ষতির পরিমাণ জেনে আমরা তা পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।

তিনি বলেন, রাসবাস দাস নামে একজনের ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সে (রাসবাস দাস) দাবি করেছে কেউ তার আইডি নকল করে এ ধরনের স্ট্যাটাস দিয়েছে। এরপরও সে মুসলমানদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। তারপরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি তদন্তের জন্য তাকে আটক করেছে। যদি সে (রাসবাস) ইচ্ছাকৃতভাবে এটা করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অপরাধীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের এ নেতা বলেন, অগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শনের অভিযোগে ছাত্রলীগ থেকে ইতিমধ্যে দুই নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

‘বাংলাদেশের নষ্ট সময় চলছে’ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এমন মন্তব্যের সমালোচনা করে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, নষ্ট সময় বলতে উনি কী বুঝিয়েছেন সেটা আমরা জানি না। এখন দেশ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের ধারায় চলছে। দেশকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসা হয়েছে। সেই সময় কোন দৃষ্টি থেকে মির্জা ফখরুল এ ধরনের কথা বলেছেন সেটা বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে নষ্ট রাজনীতি শুরু করেছিলেন মির্জা ফখরুলদের বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। তিনি ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ‘রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেবেন’ বলে যে ডায়লগটি দিয়েছিলেন সে অনুযায়ী তিনি রাজনীতি শুধু জটিল করে দেননি কুটিল করে দিয়েছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন, কৃষি ও সমবায় সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, দফতর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আফজাল হোসেন, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, বি এম মোজ্জাম্মেল হক, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক রোকেয়া সুলতানা, বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, কার্যনির্বাহী সদস্য এস এম কামাল হোসেন, আমিরুল আলম মিলন, বিপ্লব বড়ুয়া, রেমন্ড আরেং প্রমুখ।  বিডি প্রতিদিন

০২ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি‌

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে