ব্রাহ্মণবাড়িয়া : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে মন্দিরে হামলা এবং হিন্দুদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে বড় অংশই কিশোর-তরুণ। শার্ট-প্যান্ট পরা এসব হামলাকারী বাইরে থেকে আসা বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
মন্দিরে হামলার একটি এবং সমাবেশের দুটি ভিডিও চিত্র দেখে এবং প্রত্যক্ষদর্শী ও হামলার শিকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে একই তথ্য পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, নাসিরনগর সদর ইউনিয়নের লোকজন হামলায় অংশ নিলে তাদের চেনা যেত। উপজেলার গোকর্ণ, পূর্বভাগ, চাপড়তলা, ভলাকুট, চাতলপাড়, গোয়ালনগর, বুড়িশ্বর, দাঁতমণ্ডল, ফান্দাউক, হরিপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে সমাবেশে যোগ দিতে এরা এসেছিল। এদের একটি অংশ সমাবেশে যোগ না দিয়ে ভাঙচুর, লুটপাটে অংশ নেয়। আরেকটি অংশ সমাবেশ থেকেও হামলায় অংশ নেয়।
এ ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বলছেন, শনিবার দুপুর থেকেই সদর ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং হয়েছে। তাতে নানা ধরনের উসকানিমূলক কথাবার্তা বলে রোববারের সমাবেশে সবাইকে যোগ দিতে বলা হয়েছে। এসব দেখেও নিশ্চুপ ছিলেন নেতারা। এমনকি রোববারের হামলা ঠেকাতেও নেতাদের আগ্রহ দেখা যায়নি। উল্টো তরিকতপন্থী সংগঠনের সমাবেশে বক্তব্য দেন উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ টি এম মনিরুজ্জামান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমেদ, ওসি আবদুল কাদের এবং চাপড়তলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরুজ আলী।
এই সমাবেশে যোগ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও এবং ওসি জানান, পরিস্থিতি সামাল দিতেই তাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন।
নাসিরনগরের হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি আদেশ চন্দ্র দেব বলেন, ‘আমরা ক্ষতিগ্রস্ত শতাধিক লোকের সঙ্গে কথা বলেছি। সবাই বলেছেন হামলাকারীরা অপরিচিত। অন্য জায়গা থেকে এসেছে। এদের বয়স ১৩ থেকে ২০। লুটপাটেই তাদের বেশি আগ্রহ ছিল।’
ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গত রোববার ১৫টি মন্দির ও ৬০-৭০টি হিন্দু বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে আশুতোষ পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের খেলার মাঠে তৌহিদি জনতার ব্যানারে অনুষ্ঠিত সমাবেশের একটি এবং নাসিরনগর সদরের মহাকালপাড়ার গৌরমন্দিরের হামলা-ভাঙচুরের একটি ভিডিও চিত্র সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো।
উপজেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি কাজল জ্যোতি দত্ত বলেন, রোববার এলাকায় দুটি সমাবেশ ছিল। সকাল থেকেই সমাবেশে অংশ নিতে বাইরে থেকে অনেক লোকজন এসেছে। এই সমাবেশ থেকেই লোকজন বিভিন্ন মন্দিরে গিয়ে প্রতিমা ভাঙচুর ও হিন্দু পরিবারে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, রোববার কলেজ মোড়ে ও আশুতোষ মাঠে দুটি সমাবেশ হয়। কলেজ মোড়ে শান্তিপূর্ণ হলেও মাঠের সমাবেশ থেকে উসকানিমূলক কথা বলা হয়। এই সমাবেশের আয়োজক ছিলেন নাসিরনগর উপজেলা কমপ্লেক্স জামে মসজিদের ইমাম এবং উপজেলা কওমি ওলামা পরিষদের সহসভাপতি মোখলেছুর রহমান। সমাবেশে কিশোর-তরুণদের অংশগ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা শনিবার বিকেলেই সমাবেশের অনুমতি নিয়েছি। এই সমাবেশে যোগ দিতে তৌহিদি জনতা বাইরে থেকে এসেছিল। তাতে অনেক কিশোর-তরুণও ছিল। আমরা বারবার বলেছি, কেউ কোথাও হামলা চালাবেন না।’
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশের অভিযোগ, শনিবার রসরাজ দাসকে গ্রেপ্তারের পরও নাসিরনগরের ইউএনও পরদিন রোববার দুটি সমাবেশ করার অনুমতি দেন, যা পরিস্থিতি খারাপ করেছে। এসব সমাবেশের অনুমিত দেওয়ার পেছনে স্থানীয় সাংসদ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হকের ভাগনে হিসেবে পরিচিত আবদুর রহিম মাস্টারের ভূমিকা ছিল বলে জানা গেছে।
আবদুর রহিম বলেন, ‘সমাবেশের বিষয়ে শনিবার রাতে আমাকে ফোন দিয়েছিলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আহ্বায়ক রিয়াজুল করিম। এরপর আমি ইউএনওর সঙ্গে ফোনে কথা বলি। তিনি আমাকে জানান আরেক অংশও অনুমতি নিয়ে গেছে।’ তিনি হামলা ঠেকানোর সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন বলে দাবি করেন।
স্থানীয় হিন্দুদের কয়েকজনের অভিযোগ, চাপড়তলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরুজ আলীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের একটি অংশ মিছিল নিয়ে সেদিন আশুতোষ মাঠের সমাবেশে যোগ দেয়। সেখানে সুরুজ আলী উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুরুজ আলী বলেন, ‘মুসলমান হিসেবে ধর্মীয় ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়ে আমি বক্তব্য দিয়েছি। তবে কোনো উসকানি দিইনি।’
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশের অভিযোগ, বাইরে থেকে লোক পাঠানোর পেছনে সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নানের ভূমিকা ছিল। তবে তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।-প্রথম আলো
৩ নভেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর