ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে : মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী, বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক অ্যাডভোকেট ছায়েদুল হকের মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ নাসিরনগর। কাঁদছেন সবাই। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এলাকায় আসবেন বলে জানিয়েছিলেন মন্ত্রী ছায়েদুল হক।
সপ্তাহ দুয়েক আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিয়াকত আলী ঢাকায় হাসপাতালে মন্ত্রীকে দেখতে যান। তখন ছায়েদুল হক তাকে বলেছিলেন বিজয় দিবসে আমি এলাকায় যাবো, ব্যবস্থা করেন। শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তার আসা নিয়ে ইউএনও শঙ্কিত ছিলেন। তবে মন্ত্রীকে মুখের উপর কিছু বলতে পারেননি ইউএনও। ছায়েদুল হক জোর দিয়েই বলেছিলেন আমি যাবোই এলাকায়। আপনারা টেনশন নিয়েন না। বিজয় দিবসে আমি এলাকায় থাকবো।
এমন তথ্য জানান ছায়েদুল হকের নিকট আত্মীয় এম.ডি মুরাদ মৃধা। ছায়েদুল হক আসতে পারেননি। কিন্তু বিজয় দিবসের সকালেই ছড়িয়ে পড়ে তার মৃত্যুর খবর। এ মৃত্যুর খবরে স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা নাসিরনগর। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করা হয়। মৃত্যুর খবরে কান্নায় ভেঙে পড়েন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. রাফি উদ্দিন বলেন, ছায়েদুল হক মরেননি। তিনি আধ্যাত্মিক জগতে বেঁচে আছেন। তার মতো নেতার মৃত্যু নেই। আওয়ামী লীগ তার মৃত্যুতে তিন দিনের শোক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। উপজেলা বিএনপিও বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান বাতিল করে।
মন্ত্রীর জন্য বিশেষ দোয়া করে উপজেলা বিএনপির সভাপতি সৈয়দ এ.কে একরামুজ্জামান বলেন, আমরা গভীরভাবে শোকাহত। নাসিরনগরবাসী বিশাল এক নেতাকে হারিয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন নাসিরনগরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সারা দেশের তুলনায় নাসিরনগরে রাজনৈতিক সহাবস্থান অনেক ভালো ছিল। তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন। সেজন্য নাসিরনগরের মানুষ তাকে বারবার নির্বাচিত করেছেন।
গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৮টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তিনি তিন মাস ধরে নানা রোগাক্রান্ত হয়ে শয্যাসায়ী ছিলেন। মৃত্যুকালে মোহাম্মদ ছায়েদুল হকের বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি স্ত্রী ও একমাত্র ছেলেসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী এবং রাজনৈতিক শিষ্য রেখে গেছেন। তিনি ছিলেন নাসিরনগরের মাটি ও মানুষের নেতা।
তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন গ্রাম থেকে শত শত মানুষ নাসিরনগর উপজেলা সদরে ছুটে আসে। জমিতে কাজ করতে গিয়ে খবর শুনে কৃষকদের অনেকেই কাজ ফেলে ছুটে আসে উপজেলা সদরে। কুয়াশা এবং শীতের মাত্রা বেশি হওয়ায় নাসিরনগরের লোকজন এমনিতেই কিছুটা নেতিয়ে ছিলেন। নেতার মৃত্যুর খবর যেন তাদেরকে আরো অসার করে দেয়। হারিয়ে ফেলে যেন চলার শক্তি।
আজ সকাল ১০টা নাগাদ মন্ত্রীর মরদেহ পৌঁছাবে প্রিয় নাসিরনগরে। সেখানে বেলা ১১টায় আশুতোষ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তার দ্বিতীয় নামাজে জানাজা এবং বাদ জোহর পূর্বভাগ গ্রামের বাড়িতে এস.ই.এস.ডি.পি মডেল হাই স্কুল মাঠে তৃতীয় জানাজার নামাজ হবে। এরপর তাকে সমাহিত করা হবে স্থানীয় কল্লরপাড় পারিবারিক গোরস্তানে পিতা-মাতার মাঝখানে।
ছায়েদুল হক সর্বশেষ এলাকায় এসেছিলেন ১০ই আগস্ট। ১০ দিন থেকেছিলেন তিনি। শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও এই সময়ে অসংখ্য উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন করেন তিনি। কোনো কোনো কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০শে আগস্ট ঢাকায় ফেরার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে থেকেও এলাকার খোঁজ খবর রেখেছেন। দিয়েছেন এলাকার নানা উন্নয়নমূলক কাজের দিকনির্দেশনা।
ছায়েদুল হক ১৯৭৩, ৯৬, ২০০১, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে পঞ্চমবারের মতো জয়ী হন এ আসন থেকে। ২০০১ এর নির্বাচনে চট্টগ্রাম বিভাগে আওয়ামী লীগের ফল বিপর্যয়ের মধ্যেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসন থেকে জয়ী হয়ে চমক দেখিয়েছিলেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন খুবই সৎ এবং ধার্মিক। প্রত্যহ তাহাজ্জুতের নামাজ আদায় করতেন তিনি।
৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর এই নেতাকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয়। শুক্রবার রাত থেকেই মুখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে তার মৃত্যুর সংবাদ। প্রিয় মানুষটির শেষ সংবাদ জানতে রাত থেকেই তার নাসিরনগর উপজেলার পূর্বভাগ গ্রামের বাড়িতে ভিড় করতে থাকেন সাধারণ মানুষসহ দলীয় নেতাকর্মীরা।
হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের খ্যাতনামা আইজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ছায়েদুল হক ১৯৪২ সালে নাসিরনগর উপজেলার পূর্বভাগ ইউনিয়নের পূর্বভাগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম সুন্দর আলী। ১৯৬৮ সালে এম এ (অর্থনীতি) ও ৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাস করেন তিনি। ছাত্র জীবনে ছাত্রলীগের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পদার্পণ করেন তিনি।
১৯৬৫-৬৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদে ছাত্রলীগের প্যানেলে ভিপি নিবার্চিত হন। তিনি ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৬২ সালে নাসিরনগর আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। নাসিরনগরের ব্যাপক উন্নয়নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার নাম।
এখনো কয়েক শ’ কোটি টাকার কাজ চলছে তার। জেলা সদরের সঙ্গে নাসিরনগরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের এক মাইলফলক। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শফিকুল আলম এম.এস.সি, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা কামরুজ্জামান আনসারী প্রমুখ।
এমটিনিউজ/এসবি