নিউজ ডেস্ক: নাবালিকা শ্যালিকা আমরিন আক্তারের সঙ্গে সৌদি প্রবাসী ভগ্নিপতি তোফাজ্জল হকের প্রেম-ভালোবাসা চলছিলো দু’-বছর ধরে। তোফাজ্জল আমরিনকে একটি স্মার্ট মোবাইল ফোন কিনে দেয়ার মাধ্যমেই শুরু করে প্রেমের সূচনা। আর এর পরিণতিতেই স্ত্রী নাছরিন আক্তারকে হত্যা করা হয় বলে ধারণা করছে পুলিশ।
আর এতে আমরিনের প্ররোচনা থাকতে পারে বলেও ধারণা পুলিশের। তবে পুলিশ রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তোফাজ্জল শ্যালিকার সঙ্গে সম্পর্কের কথা স্বীকার করলেও অস্বীকার করে স্ত্রী হত্যার কথা। বারবার ‘আল্লাহ্র কসম’ বলে স্ত্রী হত্যার সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতা এড়িয়ে যায় সে।
স্ত্রীর মৃত্যুর পর ২ সপ্তাহ না পেরুতেই তোফাজ্জল শ্যালিকা আমরিন আক্তারকে নিয়ে উধাও হয়। এরপর ২৬শে নভেম্বর আদালতে এফিডেভিট করে তোফাজ্জল আমরিনকে বিয়ে করে।
বিয়ের ওই এফিডেভিটে বলা হয়- ‘পূর্ব পরিচয়ের সুবাদে একে-অপরের মধ্যে পরিচয় হইয়া প্রেমের সম্পর্ক গড়িয়া উঠে। আমাদের বর্তমান প্রেমের সম্পর্ক এতো বেশি গভীর আকার ধারণ করে যাহার ফলশ্রুতিতে উক্ত সম্পর্ক হইতে সরিয়া পড়া কিংবা বিচ্ছিন্ন হওয়া মোটেই সম্ভব নয়।
এমতাবস্থায় আমরা হলফকারীদ্বয় আমাদের উভয়ের অতীত ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানিয়া-শুনিয়া আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে সমৃদ্ধ করার স্বার্থে কাহারো প্ররোচনা ব্যতীত আমাদের পবিত্র ভালোবাসাকে সার্থক করার লক্ষ্যে অদ্য বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হইবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিলাম’।
এফিডেভিটে উল্লেখ করা হয় আবদুর রহমান মৌলভীর মাধ্যমে ৪ লাখ টাকা দেনমোহরে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তারা দাম্পত্য জীবনের সূচনা করেছে। আমরিন আক্তার আশুগঞ্জ রৌশন আর জলিল উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। জন্ম সনদে তার জন্ম তারিখ ২০০৪ সালের ৩০শে জানুয়ারী উল্লেখ রয়েছে। সে হিসেবে উধাও হওয়ার সময় তার বয়স ১৩ বছর ১০ মাস।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার সাদেকপুরে স্ত্রীকে হত্যা করে শ্যালিকাকে নিয়ে উধাও হওয়ার এ ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। ২০শে ডিসেম্বর মৃত্যুর এক মাস ৮দিন পর ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে লাশ উত্তোলন করা হয় গৃহবধূ নাছরিন আক্তারের। পরদিন জেলা সদর হাসপাতালে তার লাশের ময়নাতদন্ত হয়। স্ত্রীকে হত্যার পর শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে ৫ বছর বয়সী সন্তানের কথা বলে ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করে ফেলা হয় লাশ।
নানা ছলচাতুরী করে মামলাও করতে দেয়া হয়নি তখন। পরে ২৯শে নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে নাছরিন আক্তারকে যৌতুকের জন্যে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগে তার পিতা হাজী মো. ইব্রাহিম মিয়া বাদী হয়ে মামলা করেন। এতে নাছরিনের স্বামী মো. তোফাজ্জল হক (৩৫)সহ ৭ জনকে আসামি করা হয়।
অন্য আসামিরা হচ্ছে মজিবুর রহমান, মহরম আলী, ফারুক মিয়া, জামাল মিয়া, সুফিয়া বেগম, নূর ইসলাম। মামলায় অভিযোগ করা হয় আগে দাবিকৃত ৫ লাখ টাকার জন্য ১২ই নভেম্বর রাতে নাছরিনকে মারধর করতে শুরু করে আসামিরা। খবর পেয়ে নাছরিনের পরিবারের সদস্যরা সেখানে গেলে তাদের সামনেই মারধর করা হয় নাছরিনকে। একপর্যায়ে নাছরিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
এরপর আসামিরা রাতেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরে ইব্রাহিম মিয়া তার মেয়ের লাশ বাড়িতে নিয়ে আসেন। পরদিন সকালে এসে নানা ছলাকলা করে লাশ নিয়ে যায় তোফাজ্জলের পরিবারের লোকজন। তড়িঘড়ি করে লাশ দাফন করে ফেলে তারা। এদিকে এ ঘটনার ১৩ দিন পর ২৫শে নভেম্বর নাছরিনের ছোটবোন আমরিন আক্তারকে অপহরণ করে নিয়ে যায় তোফাজ্জল হক।
এ ঘটনায়ও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে মো. তোফাজ্জলকে আসামি করে ৩০শে নভেম্বর একটি অপহরণ মামলা করেন আমরিনের মা মোছাম্মৎ শাহেনা বেগম। তিনি অভিযোগ করেন ঘটনার পর থেকেই তার স্বামীকে (নাছরিন হত্যা মামলার বাদী ইব্রাহিম মিয়া) হত্যা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের অপহরণ করে নেয়ার হুমকি দিয়ে আসছিল তোফাজ্জল ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা।
হত্যা মামলাটি থানায় রেকর্ড হয় ৪ঠা ডিসেম্বর। ওইদিনই নাছরিনের স্বামী তোফাজ্জলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই মামলায় ১৭ই ডিসেম্বর থেকে ২০শে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ দিন রিমান্ডে এনে তোফাজ্জলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার এসআই শফিকুল ইসলাম জানান- জিজ্ঞাসাবাদে সে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে মুখ খুলেনি। বারবার ‘আল্লাহ্র কসম’ বলে হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে।
তিনি বলেন, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এবং ভিসেরা পরীক্ষার রিপোর্ট পেলেই মৃত্যুর কারণ পরিষ্কার হওয়া যাবে। এদিকে আমরিনকে উদ্ধার করতে পারেনি এখনো পুলিশ। আদালত আমরিন অপহরন মামলার তদন্ত দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনকে।
পরিবারের সদস্যরা জানান- ২০০৯ সালের ১০ই জানুয়ারি সাদেকপুর ইউনিয়নের আবদুল আউয়ালের ছেলে তোফাজ্জলের সঙ্গে ৩ লাখ টাকা দেনমোহরে বিয়ে হয় পার্শ্ববর্তী রাজাখা গ্রামের ইব্রাহিম মিয়ার মেয়ে নাছরিনের। বিয়ের পরই বিদেশ যাওয়ার জন্যে ৫ লাখ টাকা দাবি করে তোফাজ্জল। এই টাকা দিলে সে বিদেশ চলে যায়। চলতি বছরে আগস্টে দেশে ফিরে আসে সে। দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের এবং ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এরপর থেকেই বাবার বাড়ি থেকে ৫ লাখ টাকা এনে দিতে স্ত্রী নাছরিন আক্তারকে চাপ দিতে থাকে। এই টাকার জন্যই ১২ই নভেম্বর রাতে নাছরিনকে মারধর করতে শুরু করে। নাছরিনকে তলপেটে লাথি, শরীরে কিল-ঘুষি মেরে এবং কাঠের রোল দিয়ে মাথায় আঘাত করে এবং গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় বলে মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়- এ যাত্রায় আসার এবং বছর দু’য়েক আগে তোফাজ্জল সৌদি থেকে দেশে এসে ছুটি কাটিয়ে যায়। তখনই শ্যালিকাকে মোবাইল ফোন কিনে দেয়। এর মাধ্যমেই তাদের যোগাযোগ বাড়ে এবং সম্পর্ক গভীর হয়ে ওঠে। নাছরিনের আবুবক্কর নামে ৫ বছর বয়সী একটি সন্তান রয়েছে।-এমজমিন
এমটি নিউজ/এপি/ডিসি