ব্রাহ্মণবাড়িয়া: অঝোরে কাঁদছিলেন মা-মেয়ে। এটা আনন্দের কান্না। উপস্থিত সবার চোখেও সেই আনন্দাশ্রু। কেউ লুকিয়ে চোখ মুছছিলেন। কান্নার মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন মা। শুশ্রূষা দিয়ে তাঁকে সুস্থ করে তোলা হলো। আবার সেই আনন্দাশ্রু।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরকারি ‘শিশু পরিবারে’ গতকাল সোমবার সকালে এই দৃশ্যের অবতারণা হয়। প্রায় ১০ বছর পর ‘অচেনা’ মাকে দেখা মাত্র মেয়ে দৌড়ে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরার মিনিট খানেকের মধ্যেই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন।
হারিয়ে যাওয়া লিজিমা আক্তার ওরফে শিরিনকে আজ মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বজনদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। তবে সরকারি শিশু পরিবারেই থেকে অন্তত এসএসসি পর্যন্ত পড়তে চায় লিজিমা। পরিবারের লোকজনও এতে রাজি আছে। আপাতত সে ছুটি নিয়ে কিছুদিন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকবে।
পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লিজিমা সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার মৌতলা গ্রামের মেয়ে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে নারায়ণগঞ্জে বোনের বাড়ি থেকে হারিয়ে যায় সে। প্রায় তিন বছর পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করে আশা ছেড়েই দিয়েছিল পরিবারের লোকজন। অবশেষে মাস দেড়েক আগে তারা লিজিমার খোঁজ পায়। জানতে পারে সে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরকারি শিশু পরিবারে আছে।
লিজিমা ও তার পরিবার এবং সরকারি শিশু পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৯ সালে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত লিজিমা। একদিন বড় বোন বিথী তাকে পড়াশোনার জন্য বকাঝকা করে। একটু পরই আরেক বোনের জামাই শহিদুল ইসলাম এসে বকা দেয়। এ অবস্থায় সে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় চলে আসে লিজিমা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক নারী তাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। কিন্তু স্বামীর আপত্তির মুখে তিনি লিজিমাকে ঘরে রাখতে পারেননি। তাকে তুলে দেওয়া হয় থানা পুলিশের কাছে। সেখান থেকে সামাজিক প্রতিবন্ধী কেন্দ্রে তার ঠাঁই হয়।
লিজিমার সঙ্গে কথা হলে ওই কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা সরকারি শিশু পরিবারের উপতত্ত্বাবধায়ক রওশনারা খাতুন শিশুটির মধ্যে কিছু একটা করার আগ্রহ দেখতে পান। তাকে নিয়ে আসা হয় সরকারি শিশু পরিবারে।
রওশনারা খাতুন বলেন, ‘লিজিমার কাছে প্রতিনিয়তই ওর ঠিকানা সম্পর্কে জানতে চাইতাম। সে মৌতলা ছাড়া আর কিছু বলতে পারত না। একদিন বলল, টিভিতে সিনেমা দেখে সুন্দরবন নামটা তার মনে পড়ছে। একদিন সে সাতক্ষীরা নামটাও বলল। সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মী রায়হান রানাকে বিষয়টি জানানো হয়। তিনি লিজিমার পরিবারের সন্ধান দেন।’
রওশনারা বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত হয়ে একদিন লিজিমাকে তার মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে দেই। এরপর থেকে প্রতিদিনই সে মায়ের সঙ্গে, পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে। লিজিমা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পরীক্ষা দিচ্ছে বলে পরীক্ষার পর পরিবারের লোকজনকে আসতে বলা হয়।’
সমাজসেবা অধিদপ্তর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপপরিচালক মো. মাসুদুল হাসান তাপস বলেন, ‘ওই শিশুকে তার পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দিতে পারছি বলে যে কী পরিমাণ ভালো লাগছে তা ভাষায় বোঝানো যাবে না।’
লিজিমার বোনজামাই শহিদুল বলেন, ‘কী পরিমাণ মনঃকষ্টে যে ছিলাম তা বলে বোঝাতে পারব না। আমার শাশুড়ি তো লিজিমাকে পাওয়ার কথা জানার পর নাওয়া-খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিল তাকে দেখার জন্য। আমরা এখন অনেক খুশি।’
লিজিমার মা ফজিলা আক্তার তো ভালো করে কথা বলতেই পারছিলেন না। প্রায় ঘণ্টাখানেক সরকারি শিশু পরিবারে অবস্থানকালে তাকে সারাক্ষণ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রাখতেই দেখা যায়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার মন বলছিল মেয়েকে আমি পাব।’
কাঁদতে কাঁদতে লিজিমা বলেন, ‘আমি রওশনারা ম্যাডামসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি ভাবতেও পারিনি পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারব। আমি অনেক খুশি। তবে আমি শিশু পরিবারে থেকেই এসএসসি পর্যন্ত পড়তে চাই।’