বিশ্বজিৎ পাল বাবু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে : ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে নাসিরনগরের ধরমন্ডল গ্রাম। সড়ক পথে নাসিরনগর সদর হয়ে হবিগঞ্জ জেলার লাখাই উপজেলার প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে যেতে হয় ওই গ্রামে। আলোচনা আছে, পুলিশও এখানে আসেন ভেবেচিন্তে। সংবাদকর্মী হিসেবেও সেই চিন্তাটা মাথায়।
যে কারণে জেলা পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানিয়ে আসার পাশাপাশি স্থানীয় সহযোগিতা নেওয়া হয়। ধরমন্ডল ইউনিয়ন যে পাঁচটি গ্রাম নিয়ে গঠিত এর একটি ধরমন্ডল গ্রাম। প্রায় ২০ হাজার লোকের বসবাস। এটি বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম গ্রাম। ধর ও মন্ডল গ্রামে দুই বিশিষ্ট ব্যক্তির নামের ওপর ভিত্তি করেই গ্রামটির নামকরণ করা হয় বলে আলোচনা আছে। আঁকাবাকা বলভদ্র নদী ওই গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়ে মেঘনায় মিশেছে।
দেশের কোথাও নারী ছিন'তাইকারী ধ'রা পড়লেই উঠে আসে ধরমন্ডল গ্রামের নাম। ধ'রা পড়াদের ঠিকানা ধরমন্ডল। ওরা গ্রামটির গৃহবধূ। তবে শহরে গিয়ে ওদের পরিচিতি ছিন'তাইকারী। গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওই গ্রামের অন্তত একশ নারী ছিন'তাইকারী ধ'রা পড়ে।
এলাকায় গিয়ে ও বিভিন্নভাবে খোঁ'জ নিয়ে জানা যায়, গ্রামটির প্রায় এক হাজার নারী ছিন'তাইকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। একটি চ'ক্র নারীদেরকে লাখ লাখ টাকায় চুক্তি করে ছিন'তাইয়ের কাজে লাগায়। ছিন'তাইয়ের প্রধান টার্গেট নারীদের শরীরে থাকা স্বর্ণালংকার। বিশেষ করে স্বর্নের চেইন। চুক্তি অনুযায়ি চ'ক্রের হাতে এনে তারা এসব স্বর্ণালংকার তুলে দেয়। এ কাজে নানা কৌ'শলও কাজে লাগায় নারী ছিন'তাইকারীরা। বিশেষ করে সঙ্গে শিশু রাখাটা হচ্ছে অন্যতম কৌ'শল।
সরেজমিন : বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ধরমন্ডল যাওয়া। কথা হয় এলাকাবাসী, জনপ্রতিনিধিসহ সং'শ্লি'ষ্টদের সঙ্গে। বেরিয়ে আসে অনেক চা'ঞ্চ'ল্যকর তথ্য। তবে এ বিষয়ে সরাসরি কেউ মুখ খুলতে রাজি নন। নিজেদের নিরা'পত্তার কথা ভেবেই অনেকে তথ্য দিতে অপা'রগতা প্রকাশ করেন।
অনেকের অভিযোগ, জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলের প্রভা'বশা'লী নেতারা চ'ক্রটিকে ম'দ'দ দিয়ে থাকেন। চ'ক্রের সঙ্গে জড়িতদের পাশাপাশি ম'দদদা'তারাও এ কাজ থেকে আর্থিক লাভবান হন। দিনকে দিনে গ্রামটিতে নারী ছিন'তাইকারীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। তবে তাদের কেউ নিজ গ্রামে অ'পরা'ধ ঘ'টান না।
গ্রামের মাঝামাঝি স্থানে মুর্তুজ আলীর বাড়ি। ২০১৯ সালের ৯ মে ফেনীতে ছিন'তাইয়ের সময় ধ'রা পড়েন মুর্তুজ আলীর ছেলে রহিম মিয়ার স্ত্রী আকলিমা। বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায়, একপাশে একতলা টিপটপ দালান ঘর। আরেক পাশে টিনের ভাঙ্গা ঘর। টিনের ঘরটিতে মুর্তুজ আলী তার বড় ছেলেকে নিয়ে টিনের ঘরে থাকেন, যেটিতে এক সঙ্গে গরুরও বসবাস।
পরিবারের লোকজন ও প্রতিবেশীরা জানালেন, আকলিমার বাড়ি হবিগঞ্জের মনতলা গ্রামে। বছর তিনেক ধ'রেই ওই নারীর চলাচলে পরিবর্তন আসে। বাবার বাড়িতে যাওয়ার কথা বলে বেশিরভাগ সময়ই এলাকার বাইরে থাকেন। নানান বিষয় নিয়ে পরিবারের অন্যদের সঙ্গে বনিবনা নেই। প্রায় ঘণ্টা দু'য়েক অপেক্ষা করেও আকলিমার স্বামী রহিম মিয়ার দেখা মিলেনি। প্রথমে ঘরের বারান্দায় ভেতর থেকে তালা দেখা গেলেও পরে বাইরে থেকে তালা দেখা যায়।
গত বছর হবিগঞ্জের ঘাটিয়া এলাকায় ডিবি পুলিশের হাতে গ্রে'প্তার হওয়া আজকির মিয়ার স্ত্রী রাবেয়া জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। তবে তাকেও বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায়নি। কথা হলে ভাই রশিদ জানান রাবেয়া অন্যত্র থাকেন। বাবার পরিবারের সঙ্গে তার যোগাযোগও নেই বলে দাবি করেন তিনি।
গ্রামের সমস্যা, শিক্ষা ব্যবস্থাসহ অন্যান্য বিষয়ে খোঁ'জ নিতে এ প্রতিবেদক এসেছেন জানালেও আগে গ্রেপ্তারকৃতদের নাম ধ'রে খুঁ'জতে থাকার পরই জড়িতদের মধ্যে বাড়িতে থাকা অনেকে গা ঢাকা দেন। অনেকে আবার নিজেদের মধ্যে কা'নাঘু'ষা শুরু করেন। তবে জামিনে ছাড়া পেয়ে গ্রে'প্তারকৃতরা আবারো একই কাজে নেমেছেন বলে স্থানীয়দের অনেকে জানান।
গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছয়-সাত বছর আগে থেকেই এখানকার নারীরা ছিন'তাইয়ের মতো পেশায় জাড়ায়। বছর তিনেক ধরে ছিন'তাইকে পেশা হিসেবেই নিয়েছেন হাজার খানেক নারী। শুরুতে একজনের হাত ধ'রে আরেকজন এ পেশায় গেলেও এখন বেশিরভাগই চ'ক্রের হাতে ব'ন্দি। ওই চ'ক্রটি একেকজন নারীর সঙ্গে সর্বনিম্ন এক বছরের জন্য চুক্তি। আর চুক্তি অনুযায়ী নারীদেরকে অগ্রীম টাকা দিয়ে দেয়া হয়। চু'ক্তিতে আবদ্ধ নারী নির্ধারিত বছরে যে পরিমাণ স্বর্ণালংকার ছিন'তাই করতে পারবেন সেটা দিতে চুক্তিকারীকে দিয়ে দেবেন।
মূলত তারা দলবেঁধে এ কাজে নামেন। দেশের বিভিন্নস্থানে হোটেলে অবস্থান করে স্বর্ণের চেইন ছিন'তাই করেন। তাদের প্রধান টা'র্গেট চলার পথের নারীরা। ছিন'তাইয়ে ধ'রা পড়লে মানুষের সহানুভুতি পেতে কখনো কখনো তারা অন্যের সন্তানকেও ভাড়া করে নিয়ে আসেন।
ধরমন্ডল গ্রামের সড়ক বাজার সুপার মার্কেটের সামনে কথা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুবক বলেন, ''আমার এক নিকটাত্মীয় ছিন'তাই পেশায় জড়িত। ওই নারী গত দুই-তিন বছর ধ'রেই বেশিরভাগ সময় এলাকার বাইরে থাকেন। একবার ধ'রা পড়লেও মাস খানেকের মধ্যে ছাড়া পেয়ে আবার এ পেশায় নামেন। আর্থিকভাবে উন্নতি হওয়ায় স্বামীকে এখন আর কিছু করতে হয় না।''
ওই যুবকের অভিযো'গ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভা'বশা'লী ব্যক্তিরা এর ম'দ'দ দেন। এক জনপ্রতিনিধির ভাই, সাবেক এক মেম্বার, একজন শীর্ষ জনপ্রতিনিধির আশেপাশে থাকা একাধিক ব্যক্তি মূলত তাদের পেছনের শক্তি হিসেবে কাজ করে। যে কারণে তাদের বি'রু'দ্ধে গ্রামে কথা বলার লোকও নেই।
মোবাইল ফোন কথা হলে ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্য (মেম্বার) জানান, তার ছেলে বৌও এ ধ'রনের কাজে জড়িয়ে পড়েছিল। অন্যান্য নারীদের সঙ্গে দলবেঁধে ঢাকায় গিয়ে ছিন'তাই কাজ করত। গ্রামেরই আরেক নারীর মাধ্যমে সে এ কাজের জড়ায়। তবে তিনি মেম্বার হওয়ার পর অনেক বুঝিয়ে এ পেশা থেকে ফিরিয়ে এসেছেন।
আলোচনা করতে গিয়ে নাসিরনগরের এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ''ধরমন্ডল গ্রামের শত শত নারী ছিন'তাই পেশার সঙ্গে জড়িত। এখানকার অনেক পুরুষ চু'রিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। গ্রামটিতে মা'মলা-মো'কা'দ্দমাও প্রচুর। বেশ কিছু খু'ন খা'রাবির ঘ'টনাও ঘ'টেছে বছর দশেকের মধ্যে। পুলিশ সেখানে গেলে স্থানীয়দের সহযোগিতা নিয়ে যায়। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের সময় এক পুলিশ হা'ম'লার শি'কার হয়। এছাড়া পুলিশের বি'রু'দ্ধে একাধিক মামলাও করেছে এ গ্রামের মানুষ।''
ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. বাহার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ''মহিলারা যে বিভিন্ন জায়গায় ছিন'তাই করতে গিয়ে ধ'রা পড়ে আমরাও শুনি। তবে আমাদের কাছে এ ধ'রনের কোনো অভিযো'গ নাই।'' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ''আমরা এমন কয়েকজনকে ধ'রে থানায় দিয়েছি।''
নাসিরনগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সাজেদুর রহমান বলেন, ''কোথাও চেইন চুরির ঘ'টনা ধ'রা পড়লেই শুনা যায় এরা ধরমন্ডলের মহিলা। বিভিন্ন সময়ে ওয়া'রেন্ট এলে আমরা তাদেরকে গ্রে'প্তার করি। এছাড়াও স্থানীয়ভাবে অভি'যোগের ভিত্তিতে কয়েকজনকে গ্রে'প্তার করা হয়েছে।''
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ''আমার পূর্বের কর্মস্থলে থাকার সময়ও ধরমন্ডলের নারী ছিন'তাইকারিরা ধ'রা পড়ে। যতটুকু জানতে পেরেছি তারা একটি চ'ক্রের হয়ে কাজ করে। চ'ক্রটি তাদেরকে চু'ক্তিভিত্তিক অর্থ পরিশো'ধ করে কাজে লাগায়। দলব'দ্ধ থেকে বিভিন্ন কৌ'শলে তারা ছিন'তাইয়ের ঘ'টনাগুলো ঘ'টায়। যাতায়াত ব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় আগে ধরমন্ডলে পুলিশ গিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া একটু ক'ঠিন ছিল। কিন্তু এখন এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে। আশা করি কিছু প'দক্ষেপ নিয়ে এ অবস্থা থেকে পরি'ত্রাণ সম্ভব।'' সূত্র : কালেরকণ্ঠ