আতাউর রহমান: দেশে সাম্প্রতিক জঙ্গি উত্থানের পেছনে যে বড় ধরনের অর্থদাতা ও পৃষ্ঠপোষক রয়েছে, তা গোয়েন্দারা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন। তারা জঙ্গিদের অস্ত্র কেনা, বাসা ভাড়া করে আস্তানা তৈরি, খাবার খরচ ও গাড়িতে নিয়ে স্থান পরিবর্তনের যাবতীয় খরচ বহন করে আসছে। পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও এরই মধ্যে গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলাকারীদের সন্দেহভাজন পাঁচ অর্থদাতাকে চিহ্নিত করেছেন গোয়েন্দারা।
তাদের মধ্যে দেশের মধ্যম সারির একাধিক ব্যবসায়ী রয়েছেন। অর্থদাতা এসব ব্যবসায়ী নিজের ব্যবসার আড়ালে মূলত জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করেন। এ ছাড়া জঙ্গিদের অর্থদাতা হিসেবে সন্দেহের তালিকায় একাধিক প্রবাসী ও অর্থ স্থানান্তরে কয়েকজন হুন্ডি ব্যবসায়ীও রয়েছেন।
যারা এর আগেও বিভিন্ন সময়ে জঙ্গি পৃষ্ঠপোষকতায় অবৈধ পথে বিপুল অঙ্কের টাকা পাঠিয়েছিলেন। সর্বশেষ গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার আগে ঢাকার দুই হুন্ডি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে 'নব্য জেএমবি'র দুই নেতা তিন দফায় ৫০ লাখ ৪০ হাজার টাকা রিসিভ করে। গোয়েন্দাদের ধারণা, এসব টাকা সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার অস্ত্র কেনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে ব্যয় হচ্ছিল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সন্দেহভাজন ব্যবসায়ী ও প্রবাসীদের বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য থাকলেও তদন্তের স্বার্থে তাদের পরিচয় এখনই প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। চূড়ান্ত তথ্য-প্রমাণ পেলেই তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে।
গুলশান হামলা তদন্তে সংশ্লিষ্ট একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার মাসখানেক আগে তিন দফায় ৫০ লাখ ৪০ হাজার টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ওই টাকাগুলো 'নব্য জেএমবি'র 'স' আদ্যক্ষরের এক নেতাসহ অপর একজন রিসিভ করেন। ধারণা করা হচ্ছে, এসব টাকা গুলশান ও শোলাকিয়া হামলায় অস্ত্র কেনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, টাকাগুলো মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে হিন্দু ব্যবসায়ী পরিচয়ে দেশে পাঠানো হয়। সরাসরি মধ্যপ্রাচ্য থেকে তা না পাঠিয়ে দুবাই-পাকিস্তান-ভারতের পাটনা-বিহার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে দুই হুন্ডি ব্যবসায়ীর কাছে। ওই দুই হুন্ডি ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে।
হিন্দু ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে টাকা পাঠানো ও এ দেশে টাকাগুলোর রিসিভার হিন্দু পরিচয় দিলেও মূলত তারা জেএমবির সদস্য। পরিচয় গোপন ও সন্দেহ এড়াতে তারা ছদ্মনাম ধারণ করে থাকে। তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, দুই বছর ধরে নিষিদ্ধ জেএমবির একটি অংশ নিজেরাই নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে বড় ধরনের তহবিল গড়ে তোলে। তহবিল বাড়াতে তারা ডাকাতি-ছিনতাইও করে।
বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া নিষিদ্ধ সংগঠনটির সদস্যরা জানিয়েছিল, ডাকাতি-ছিনতাইয়ের টাকা তারা 'গনিমতের মাল' বলে মনে করে। এসব অর্থ তারা নিজেদের কর্মী সংগ্রহ ও থাকা-খাওয়ার কাজে ব্যবহার করছে। পাশাপাশি তাদের 'শুভাকাঙ্ক্ষীরা'ও তহবিল গড়তে সহায়তা করছে।
এ ধরনের কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, তদন্তে দেখা গেছে, কয়েক বছরে বর্তমানে সক্রিয় থাকা জেএমবির নতুন ধারার অংশটি আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতি করেছে। নারায়ণগঞ্জে ৬৫ লাখ টাকা ও গাইবান্ধায় ৩৭ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামেও তারা বড় অঙ্কের টাকা ছিনতাই করেছে।
অন্য এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ছয় মাস আগে স্পেন থেকে এক প্রবাসী ঢাকায় তার বাবার কাছে হুন্ডির মাধ্যমে ৩৮ লাখ টাকা পাঠিয়েছিলেন। ডিবি পুলিশ ওই টাকাসহ প্রবাসীর বাবাকে গ্রেফতার করে। এরপর তার কাছ থেকে জঙ্গি অর্থায়ন সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।
ওই সময় তিনি জানিয়েছিলেন, তার ছেলে টাকাগুলো এক ব্যক্তিকে দিতে বলেছিলেন। পরে দেখা যায়, ওই প্রবাসীও জঙ্গি সংগঠনের সদস্য এবং যাকে টাকাগুলো দেওয়ার কথা ছিল তিনিও জঙ্গি দলের। গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পর ওই প্রবাসীসহ আরও অন্তত তিন প্রবাসীকে সন্দেহের তালিকায় রেখে তার স্বজনদের যোগাযোগ মনিটর করা হচ্ছে।
পাশাপাশি চিহ্নিত কয়েকজন হুন্ডি ব্যবসায়ীকেও নজরদারিতে নেওয়া হয়েছে। কয়েক মাসে তাদের টাকা লেনদেনের হিসাব যাচাইয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বেশ কিছু জঙ্গি-সংক্রান্ত মামলা তদন্ত ও গ্রেফতার জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন এমন এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন সময়ে অবৈধ পথে জঙ্গি অর্থায়নে বড় অঙ্কের টাকা আসার তথ্য রয়েছে। চ্যানেলগুলো অবৈধ হওয়ায় সরাসরি তাদের শিকড়ে আঘাত করা সম্ভব হয় না।
তা ছাড়া জঙ্গিদের বড় তহবিলের মধ্যে সরাসরি হামলায় অংশ নেওয়া জঙ্গি সদস্যরা কিছুই পায় না। তাদের ধর্মের কথা বলে অল্প খরচে জীবন-যাপন করানো হয়। শুধু অস্ত্র কিনতেই কিছু টাকা খরচ হয়। মূলত নাশকতা ও হামলার পরিকল্পনাকারীদের কাছেই এসব টাকা থাকে।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার আবদুল মান্নান বলেন, কল্যাণপুরে আটক জঙ্গি রাকিবুল হাসান ওরফে রিগানকে তাদের অর্থদাতা হিসেবে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে জানিয়েছে, মাঝে মধ্যে তাদের 'বড় ভাইয়েরা' এসে বাজার খরচের টাকা দিয়ে যেত। অস্ত্র ও বিস্ফোরকও তারা দিত। তার দেওয়া তথ্যগুলোও যাচাই করা হচ্ছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে জঙ্গি ছিনতাইয়ের অর্থদাতা তৈরি পোশাক কারখানার মালিক রাহাত ও আজমীরকে গ্রেফতার করেছিল ঢাকার ডিবি পুলিশ। কল্যাণপুরে রাহাতের ও বাড্ডার সাঁতারকুলে আজমীরের গার্মেন্ট কারখানা রয়েছে।
গত বছর চট্টগ্রামে এক জঙ্গিগোষ্ঠীকে বিপুল অঙ্কের অর্থ দিয়ে র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন টঙ্গীর এনামুল নামের এক ব্যবসায়ী। তারা কারাগারে থাকলেও বাইরে তাদের সহযোগীদের বিষয়ে নজরদারি শুরু হয়েছে।
গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলা এবং কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় ৯ জঙ্গির নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের মামলাগুলোর তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও বলছেন, নতুন ধারার জেএমবির পলাতক শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরী দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলেন। তার সঙ্গে বিদেশি অর্থদাতার সংশ্লিষ্টতাও থাকতে পারে। তাকে গ্রেফতার করা গেলে জঙ্গি অর্থায়নের অনেক কিছুই বের হবে।-সমকাল
১০ আগস্ট ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সবুজ/এসএ