নওশাদ জামিল: কমলাপুর স্টেশনে ঢোকার মুখেই পড়ে বড় একটি আঙিনার মতো জায়গা। রাত তখন সাড়ে ১২টা, দেখা গেল সেই আঙিনায় শুয়ে আছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। কেউ মেঝেতে পত্রিকা বিছিয়ে ঘুমাচ্ছেন, কেউ বা শুয়ে আছেন চটের বস্তার ওপর। তাঁদের মধ্যে আলাদা করে নজর গেল এক তরুণের দিকে। মেঝেতে চাদর বিছিয়ে একমনে বই পড়ছিলেন। একই বিছানায় তাঁর পাশে আরেকজন ঘুমাচ্ছেন। মনে হলো, হয়তো সকালের ট্রেনে কোথাও যাবেন, তাই আগেভাগেই স্টেশনে চলে এসেছেন। সময় কাটাচ্ছেন গল্পের বই পড়ে।
কিন্তু কাছে গিয়ে ভুল ভাঙল। ওই তরুণ জানালেন তাঁর নাম মো. ওমর ফারুক। বললেন, ‘ঢাকা কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি। ঢাকায় এসেছি কয়েক মাস হয়েছে। হলে সিট পাইনি। কোথাও বাসাভাড়াও পাইনি। তাই কমলাপুর রেলস্টেশনে থাকি।’
পাশে যিনি ঘুমাচ্ছিলেন আমাদের কথাবার্তায় ততক্ষণে তাঁর ঘুম ভেঙে গেছে। জানালেন, তাঁর নাম মো. শাহজাহান মিয়া। ঘুম তাড়াতে চোখ কচলাতে কচলাতে বললেন, ‘কুমিল্লার দেবিদ্বারে আমার বাড়ি। চাকরির সন্ধানে ঢাকায় এসেছি দুই মাস হয়ে গেছে। কোথাও চাকরি পাইনি। মিরপুরে একটি মেসে থাকতাম। জঙ্গি হামলার পর বাড়িওয়ালা সেই মেস বন্ধ করে দিয়েছেন। কোথাও থাকার জায়গা না পেয়ে এখন স্টেশনেই থাকি।’
অদূরেই কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের এক কোণায় মেঝেতে পত্রিকা বিছিয়ে গল্প করছিলেন দুই তরুণ। তাঁদের পরনে প্যান্ট, গায়ে শার্ট। পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের কথা শোনার চেষ্টা করি। একজন আরেকজনকে বলছিলেন, ‘বিয়ে যে করব, বউকে কী খাওয়াব। বেকার ছেলেকে কেউ মেয়ে দিতে চায় না।’
তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, দুজনের বাড়িই পঞ্চগড়ে। চাকরির সন্ধানে ঢাকায় এসেছেন। কিন্তু চাকরি জোটেনি এখনো। ঢাকায় কোথাও থাকার জায়গাও নেই। কিছুদিন একটা মসজিদে ছিলেন। এখন থাকছেন কমলাপুর স্টেশনে।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে থাকা আরো কয়েকজন ব্যাচেলর বললেন, স্টেশনে যাত্রীদের জন্য বাথরুমের ব্যবস্থা আছে। তবে সেখানে বাথরুম করতেও টাকা লাগে। গোসল করতে লাগে ১০ টাকা। বাথরুম করতে লাগে পাঁচ টাকা।
গত বৃহস্পতিবার রাতে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ঘুরে ব্যাচেলরদের এমন দুর্বিষহ চিত্র পাওয়া গেছে। রাজধানীতে থাকার জায়গা নিয়ে ব্যাচেলরদের দুর্ভোগ নতুন কিছু নয়। বেশির ভাগ আবাসিক এলাকায় বাড়ির মালিকরা ব্যাচেলরদের বাড়িভাড়া দিতে চায় না।
বিশেষ করে গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলা, কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযান, কয়েকটি মেসে জঙ্গি আস্তানার খোঁজ পাওয়ার পর ব্যাচেলরদের সেই দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।
শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীসহ লাখো ব্যাচেলর একটুখানি মাথাগোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য হাপিত্যেশ করছে। জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত থাকতে পারে এই সন্দেহে কোনো এলাকাতেই বাড়িওয়ালারা আর ব্যাচেলরদের বাড়িভাড়া দিতে চাচ্ছে না।
একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রাজধানীর মেসগুলো। কোথাও থাকার জায়গা না পেয়ে অনেকেই রাজধানীর বিভিন্ন মসজিদে রাত কাটাচ্ছে। রাত হলে অনেকে ভিড় করছে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে।
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ওমর ফারুক জানান, গত ৫ মে তিনি ঢাকা কলেজে ব্যবস্থাপনা বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছেন। তাঁর বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলায়। অনেকবার তিনি চেষ্টা করেছেন হলের সিট পেতে। কিন্তু পাননি। পরে বাধ্য হয়ে আজিমপুরে একটা মেসে উঠেছিলেন। দেড় মাস আগে বাড়িওয়ালা সেই মেস বন্ধ করে দিয়েছেন।
ঢাকায় তাঁর আপন কেউ নেই। একা বাসা নেওয়ার মতো আর্থিক সংগতিও নেই। এর পরও চেয়েছিলেন কয়েক বন্ধু মিলে বাসা ভাড়া করে থাকবেন, কিন্তু কোথাও বাসাভাড়া মেলেনি।
দুর্ভোগ ও কষ্টের কথা জানিয়ে ওমর ফারুক বলেন, ‘কোথাও বাসা ভাড়া না পেয়ে ভেবেছিলাম গ্রামে চলে যাব। কিন্তু গ্রামেও অনেক সমস্যা। মা মারা গেছেন ৯ বছর আগে। পরে বাবা বিয়ে করেছেন। সত্মা আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন। এ অবস্থায় আর গ্রামে ফিরে যাওয়া হয়নি।’
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে কবে থেকে থাকছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দেড় মাস ধরে কমলাপুরে থাকছি। মেঝেতেই থাকি। ব্যগটা বালিশ হিসেবে ব্যবহার করি। সকালে ব্যাগ গুছিয়ে কলেজে যাই। বিকেলে চাকরি খুঁজি। কোনো দিন খাওয়া হয়, কোনো দিন হয় না।’
গত কয়েক দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে ব্যাচেলরদের দুর্বিষহ জীবন দেখা গেছে। ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে রাজধানীর অনেক মেস। ব্যাচেলররা কোথাও বাসাভাড়া পাচ্ছে না। কোথাও বাড়ির মালিক ব্যাচেলরদের ভাড়া দিতে রাজি হলেও বিনিময়ে অনেক বেশি ভাড়া চাইছেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর নিচতলা বা চিলেকোঠায় ভাড়া মিললেও সেখানেও নানা উটকো শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় ব্যাচেলরদের জন্য। সব মিলিয়ে বাসাভাড়া পাওয়ার ক্ষেত্রে চরম সংকটে পড়েছে ব্যাচেলররা।
জানা যায়, রাজধানীতে ব্যাচেলর বাসাভাড়া নিয়ে যারা থাকে, তাদের একটা বড় অংশই শিক্ষার্থী। বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তারা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবাস না থাকায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে মেসে থাকতে হয়। ব্যাচেলরদের একটা বড় অংশ চাকরিজীবী। কিছু আছেন ব্যবসায়ী। কিছু আছেন চাকরিপ্রার্থী।
ঢাকায় চাকরির সন্ধানে এসে মেসে থাকছেন এমন মানুষের সংখ্যাও প্রচুর। আবার কিছু ব্যাচেলর চাকরি করলেও নানা কারণেই পরিবার থেকে আলাদা থাকেন। কিছু আছেন বিবাহিত। কিন্তু একা থাকেন বলে তাঁরাও ব্যাচেলর। সাম্প্রতিক সময়ে এই বিপুলসংখ্যক মানুষ আবাসন সংকটে পড়েছে।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর মধুবাগে একটি মেসে কথা হয় কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তাদের মধ্যে আমজাদ হোসেন এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং করতে ঢাকায় এসেছে। কোথাও থাকার জায়গা না পেয়ে এক পরিচিতের মাধ্যমে মধুবাগের একটি মেসে উঠেছে। মেসে পড়াশোনার সমস্যা হচ্ছে তার।
এ অবস্থায় কোচিংয়ের কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে নিজেরাই একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বাসা পাচ্ছে না কোথাও। বাড়িওয়ালাদের এক কথা ব্যাচেলরকে ভাড়া দেওয়া হবে না। উপায় না পেয়ে মধুবাগের মেসটিতেই থাকতে হচ্ছে তাকে।
মধুবাগের হাতিরঝিলের কাছেই সেই মেস। গতকাল দুপুরে ঘুরে দেখা যায়, টিনশেড বিল্ডিংয়ের চারটি মাঝারি আকারের কক্ষ। তাতে গাদাগাদি করে থাকছে ১৮ জন। তাদের কেউ শিক্ষার্থী, কেউ হকার, কেউ ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
সেখানে দেখা যায়, ১৮ জনের জন্য দুটি মাত্র বাথরুম। প্রতিদিনই সকাল-সন্ধ্যা বাথরুমে যাওয়ার জন্য লাইন ধরতে হয়। সময় অনুযায়ী গোসল করতে না পারলে পরে আর গোসল করাই হয় না।
বিভিন্ন বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকায় নতুন আসা শিক্ষার্থীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন বেশি। বাসা বদল বা নতুন করে বাসা নিতে যাওয়ায় নানা বিড়ম্বনা।
তরিকুল ইসলাম নামে নটর ডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী বললেন, ‘এখন যে মেসে আছি, সেখানে থাকাটা খুব কষ্টকর। কয়েক বন্ধু মিলে বাসাভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করছি। কয়েকটি বাসায় টু-লেট দেখে বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছি। সবাই মুখের ওপর না করে দিচ্ছেন। অথচ আগেও এসব বাসা ব্যাচেলরদের ভাড়া দেওয়া হতো। কিন্তু জঙ্গি হামলার ঘটনার পর এখন বাসা পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে।’
গত বৃহস্পতিবার রাজধানী বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বাড়ির মালিক ও ব্যাচেলর ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দুই পক্ষই বিড়ম্বনার ভুগছে। গুলশান, শোলাকিয়া ও কল্যাণপুরের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বাড়ির মালিকরা গ্রেপ্তার হওয়ায় এখন আর মেস ভাড়া দিতে আগ্রহী নন বাড়িওয়ালারা।
রাজধানীতে মেসের জন্য পরিচিত আরামবাগ, ফকিরাপুল, কল্যাণপুর ঘুরে দেখা যায়, রাস্তায় ‘টু-লেট’ ঝুললেও তা ব্যাচেলরদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কল্যাণপুরের এক চিলেকোঠায় কয়েকজন ব্যাচেলর থাকেন।
কিন্তু আগামী মাসে সেখানে ফ্যামিলি ভাড়া দেওয়া হবে লেখা টু-লেট লাগানো হয়েছে। বাড়ির মালিক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, গোটা কল্যাণপুরেই এখন ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া দেওয়া হচ্ছে না। ব্যাচেলরদের অনেক সমস্যা। এ কারণে আগামী মাস থেকে ফ্যামিলি ভাড়া দেওয়া হবে।’
কল্যাণপুরের সেই বাসায় থাকা ব্যাচেলর কল্লোল হোসেন বলেন, ‘অল্প কিছুসংখ্যক বিপথগামী জঙ্গি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপরাধের দায় লাখ লাখ ব্যাচেলরের ওপর বর্তানো উচিত নয়। রাজধানী থেকে মেস তুলে দেওয়া হলে লাখ লাখ ব্যাচেলর ভাড়াটিয়া বিপদে পড়বে। আমি বাড়িওয়ালার কাছে নিজের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দিয়েছি। এর পরও বাড়ি মালিক বলছেন, ব্যাচেলর আর রাখবেন না।’
বাসা ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে নানা সমস্যার কথা জানিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আনছারুল তালুকদার বলেন, ‘এক মাস ধরে ফার্মগেট, হাতিরপুল, কাঁঠালবাগান এলাকায় বাসা খুঁজছি। কিন্তু পরিবার না থাকায় এখনো বাসা জোটেনি। সবখানেই বাড়ির মালিকরা ব্যাচেলর শুনেই বাসাভাড়া দিতে চাচ্ছেন না। টু-লেটের বিজ্ঞপ্তি দেখে ফোন দেওয়ার পর ব্যাচেলর শুনেই লাইন কেটে দেন বাড়ির মালিকরা।’
বাড়ির মালিকরা বলছেন, ব্যাচেলরদের বাড়িভাড়া দিলে পুলিশ নানাভাবে হয়রানি করে। এ ছাড়া পুলিশ যেকোনো সময় ব্যাচেলর বাসায় হানা দিতে পারে। এ ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়। তাই তাঁরা ব্যাচেলরদের বাড়িভাড়া দিতে চান না।
তবে রাজধানীতে ব্যাচেলরদের বাসাভাড়া দেওয়া বা না দেওয়ার বিষয়ে বাড়ির মালিকদের কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি বলে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ভাড়াটিয়া ভাড়াটিয়াই, কে ব্যাচেলর কে বিবাহিত সেটা বড় কথা নয়। মূল বিষয়টা হলো ভাড়াটিয়াদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহে রাখা উচিত। এবং তা নিকটস্থ থানায় জমা দেওয়া উচিত।
বাড়ির মালিক কাকে ভাড়া দেবেন, কাকে দেবেন না, এটা তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা শুধু চাই সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। সে জন্য ভাড়াটিয়াদের তথ্য জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।’-কালের কন্ঠ
২৭ আগস্ট,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ