নাদিম হোসেন, সাভার : মুর্হূতের মধ্যেই আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে নিচ তলা থেকে ৫ তলা পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। এ সময় অনেক শ্রমিকই ছাদ ও জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে বা ভবনের পাইপ বেয়ে জীবন বাঁচাতে পারলেও ১১২ জন শ্রমিকের জীবনের আলো কেড়ে নেয় আগুনের লেলিহান শিখা। আর আহত হন অন্তত তিন শতাধিক শ্রমিক।
ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। চার বছর আগে আজকের এই দিনে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় তোবা গ্রুপের তাজরিন ফ্যাশনস পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেদিনের আগুনের লেলিহান শিখা থেকে অনেক শ্রমিক রক্ষা পেলেও আজও সেদিনের ভয়াবহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে। এদিকে, সাক্ষী জটিলতায় চার বছরেও শেষ ১১২ জন শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনার বিচার।
তাজরিন কারখানায় সরেজমিনে দেখা যায়, ভয়াল সেই অগ্নিকাণ্ডের ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কারখানার ভবনটি। প্রধান ফটকটিতে ঝুলে আছে তালা। ভাঙা জানালার গ্লাসগুলো তাকিয়ে আছে সড়কের দিকে। কর্মচঞ্চল ভবনটি এখন রূপ নিয়েছে ভূতুড়ে বাড়িতে। ভবনটির চারপাশের দেয়ালেই গজাতে শুরু করেছে ছোট ছোট গাছ। এ যেন এক প্রচীন ভবন।
ভবনটির বাইরে অবস্থান করতে দেখা যায় অগ্নিকাণ্ডের দিন ভবনের ভেতরে থাকা কয়েকজন শ্রমিককে। কথা হয় তাদের সঙ্গে। তাদের একজন লিয়ন। পরিবারের বাবা-মা, ভাই-ভাবিকে হারিয়ে তিনি নিঃস্ব প্রায়। এখন থাকেন বোনের বাসায়। মা-ভাইয়ের মৃতদেহ পেলেও বাবা-ভাবির মরদেহও পাননি। সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক অনুদান পেলেও একটিবারের জন্যও ভুলতে পারছেন না তাদের স্মৃতি। বললেন, ‘মনে হয় এই বুঝি বাবা আমাকে ঠেলে বলছে আমাকে বাঁচাও। এ যে কী যন্ত্রণার তা বলে বুঝানো যায় না।’
অগ্নিকাণ্ডে আহত দুই শ্রমিক আয়শা আর পারভিন। তারা জানান, তখনকার সহকর্মীদের বাঁচার আকুতি এখনও কানে বেজে ওঠে। বলেন, ‘মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যায় বাঁচাও-বাঁচাও আর্তনাদে। শরীরের এখনও প্রচণ্ড ব্যথ্যা। ডাক্তার বলেছেন যতদিন বেঁচে থাকব, এ ভাবেই বেঁচে থাকতে হবে। এক সময় কর্মক্ষম মানুষ এখন অক্ষম হয়ে বেঁচে আছি। অভাবের সংসারে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছি। এর চেয়ে মৃত্যুও ভালো ছিলো।’
আগুনে নিহত ও আহত শ্রমিকদের সরকার ও বিজেইএমই-এর পক্ষ থেকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও এখনও অনেক শ্রমিকের অভিযোগ, তারা ক্ষতিপূরণ পাননি।
আসলাম মিয়া আর জাহানারা বেগম জানান, অগ্নিকাণ্ডের পর নিজেদের চিকিৎসা চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। ঘটনার পর কোথাও থেকে একটি টাকাও ক্ষতিপূরণ তারা পাননি। তাদের অভিযোগ, অনেকে মিথ্যা নাম দিয়ে টাকা তুলেছে আর তারা প্রকৃত আহত শ্রমিক হয়েও কোনও ক্ষতিপূরণ পাননি। দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনও ফয়দা হয়নি। জানালেন, এখন সব ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ বস্ত্র ও পোশাক শিল্প শ্রমিক লীগের সাভার-আশুলিয়া থানা কমিটি সভাপতি মো. সরোয়ার হোসেন ক্ষতিপূরণের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘একটু দেরিতে হলেও সরকার ও বিজিএমইএ নিহত ও আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ করেছেন। তবে যেসব যারা আহত তাদের সু-চিকিৎসার ব্যবস্থা করে পূর্ণবাসন করলে এসব শ্রমিকরা ভয়কে জয় করে নতুন করে বাঁচতে পারত।’ সরকার দ্রুত আহত শ্রমিকদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে বলে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
এদিকে সাক্ষীর জটিলতার কারণে চার বছরেও বিচার হয়নি ১১২ শ্রমিক নিহতের মামলাটি। প্রায় দেড় বছর আগে অভিযোগ গঠন করা হলেও এখনও শেষ হয়নি বিচার। আদালতে সাক্ষী হাজির না হওয়ায় এ জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। আদালত সূত্রে জানা গেছে, মামলায় মোট ১০৪জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এ পর্যন্ত মাত্র পাঁচজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এখনও ৯৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ বাকি রয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের পরদিন আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় নাশকতার পাশাপাশি অবহেলাজনিত মৃত্যুর ধারাও যুক্ত করা হয়। এর প্রায় এক মাস পর মামলাটি সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়। পরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক একেএম মহসিনুজ্জামান খানা ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ মামলার চার্জশিট দাখিল করেন। এতে তাজরিন ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দেলোয়ার হোসেন ও চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার মিতাসহ প্রতিষ্ঠানের ১৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। -বাংলা ট্রিবিউন।
২৪ নভেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম