বুধবার, ০২ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০৬:২৪

আলাদা করার পর ভালো আছে তোফা-তহুরা

আলাদা করার পর ভালো আছে তোফা-তহুরা

ঢাকা: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) চিকিৎসাধীন শিশু তোফা ও তহুরার শারীরিক অবস্থা ভালো আছে। অস্ত্রোপচারের ধকল গেলেও বুধবার সকাল পর্যন্ত শারীরিকভাবে তাদের বড় ধরনের কোনো জটিলতা দেখা দেয়নি।

এর আগে মঙ্গলবার কোমরে জোড়া লাগানো অবস্থায় জন্ম নেয়া যমজ শিশু তোফা ও তহুরাকে জটিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা করেছেন চিকিৎসকরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এক দল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সার্বিক তত্ত্বাবধানে মঙ্গলবার ৯ ঘণ্টা ধরে চলে এ অস্ত্রোপচার।

ঢামেক কর্তৃপক্ষ বেলা ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে তোফা ও তহুরার অস্ত্রোপচার পরবর্তী শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে গণমাধ্যমকে অবহিত করবে।

এদিকে অস্ত্রোপচারের পর শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হানিফ বলেন, বিকাল ৫টার দিকে তোফা ও তহুরার জ্ঞান ফিরেছে। তাদের সফল অস্ত্রোপচার হয়েছে। তবে এখনও ঝুঁকিমুক্ত বলা যাবে না। সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে। তাই তাদের দেখতে গিয়ে অহেতুক ভিড় না করতে সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

ঢামেক হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহনুর ইসলাম জানান, শিশু দুটির বয়স ১০ মাস। তাদের স্পাইনাল কর্ড, মেরুদণ্ড, পায়খানার রাস্তা ও প্রস্রাবের রাস্তা একটাই ছিল। তবে মাথা-হাত-পা ছিল আলাদা। ১৬ জন সার্জন মিলে এ অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেন। তোফা-তহুরা যেভাবে জোড়া লাগানো ছিল, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘পাইগোপেগাস’। দেশে ‘পাইগোপেগাস’ শিশু আলাদা করার ঘটনা এটাই প্রথম। এর আগে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে তিন জোড়া শিশুকে আলাদা করা হয়েছে। তবে যেসব শিশুকে আলাদা করা হয়েছিল, তাদের ধরন আলাদা ছিল।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মঙ্গলবার সকাল ৮টার দিকে তোফা-তহুরার অস্ত্রোপচার শুরু হয়। বেলা আড়াইটার দিকে প্রাথমিকভাবে অস্ত্রোপচার শেষ হয়। পরে ঢামেক হাসপাতালের চিকিৎসক রাজিউল হাসান, এসএম শফিকুল আলম, অসীত চন্দ্র সরকার, আশরাফুল হক, আবদুল হানিফ ও কানিজ হাসিনা পৃথকভাবে প্রায় একই ধরনের তথ্য দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, দুই শিশুর স্পাইনাল কর্ড, মেরুদণ্ড, পায়খানার রাস্তা ও প্রস াবের রাস্তা আলাদা করা হয়েছে। জটিল এ অস্ত্রোপচারের সার্বিক তত্ত্বাবধান করছেন ঢামেকের শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহনুর ইসলাম।

প্রথম ধাপের অস্ত্রোপচার শেষে দুপুরের পর পরই ৯০ শতাংশ অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। অপারেশন পুরোপুরি শেষ হতে প্রায় ৯ ঘণ্টা সময় লাগে। তবে অস্ত্রোপচার সফল হলেও পুরোপুরি সুস্থ হতে শিশু তোফা ও তহুরার আরও বেশকটি অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে। এ ধরনের অপারেশনের পর কিছুটা ঝুঁকি থাকলেও চিকিৎসকরা আশাবাদী, সুস্থ হয়ে মায়ের কোলে ফিরবে দুই শিশু।

বেলা আড়াইটার দিকে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক কানিজ হাসিনা শিউলি সাংবাদিকদের বলেন, ওরা দু’জন এখন আলাদা। দু’জনের অবস্থাই স্থিতিশীল। এখনও কিছু রিপেয়ারের কাজ বাকি আছে। আরও দুই-তিন ঘণ্টা সময় আমাদের লাগবে।

এরপর বিকাল ৫টায় সহযোগী অধ্যাপক শাহানুর ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, শিশু দুটিকে সকাল ৮টায় অজ্ঞান করা হয়। অজ্ঞান ছিল ৫টা পর্যন্ত। আমরা ভয়ে ছিলাম, বাচ্চা দুটি রিকভারি করবে কিনা? কিন্তু বাচ্চাগুলো খুব সুন্দর করে কান্না করেছে। হাত-পা নেড়েছে। প্রস্রাব-পায়খানার বিষয়টা আরও কিছুদিন যাওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে। প্লাস্টিক সার্জারি, নিউরো সার্জারি, প্যাডেথিক সার্জারি, এনেসথেসিয়া সব বিভাগের চিকিৎসকরা মিলে আমরা দীর্ঘ সময় কাজ করেছি। সঙ্গে ছিলেন সিস্টার, ওয়ার্ডবয়, ওটিবয়সহ অন্যরা। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ ধাপ পার হয়ে আসছি। কিন্তু বাচ্চা দুটি ইনফেকশনের জন্য যে কোনো সময় সমস্যায় পড়ে যেতে পারে।

তিনি আরও বলেন, এ অপারেশন আসলেই চ্যালেঞ্জিং বিষয়। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা সফল। শিশুদের পায়ুপথ ও মাসিকের রাস্তা পাতলা পর্দার মতো ছিল। তা পরে মেরামত করা হবে। সেপারেশন সার্জারি বলতে যা বোঝায় তাতে আমরা সফল।

২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার রাজ মিয়ার স্ত্রী সাহিদা আক্তার এ জোড়া শিশুর জন্ম দেন। ৭ অক্টোবর ৯ দিন বয়সে জোড়া শিশু দুটিকে চিকিৎসার জন্য ঢামেক হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে জোড়া শিশু দুটির প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করা হয়। তখন ছোট একটি অপারেশনের মাধ্যমে তাদের পায়খানার রাস্তা আলাদা করে দেয়া হয়। এরপর তাদের শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা ও পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল।

দীর্ঘ ১০ মাস প্রাথমিক চিকিৎসা ও পর্যবেক্ষণে রাখার পর তোফা ও তহুরার অস্ত্রোপচার করেন চিকিৎসকরা। দেরিতে শিশু দুটিকে আলাদা করা প্রসঙ্গে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মিজানুর রহমান জানান, প্রথমদিকে শিশু দুটির ওজন কম ছিল। তাদের রক্তে সেপটিসেমিয়া ছিল, যা অস্ত্রোপচারের জন্য উপযুক্ত ছিল না। তাদের অস্ত্রোপচারের জন্য উপযুক্ত করে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে।

এ অস্ত্রোপচারকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষায় রয়েছেন সংবাদমাধ্যম কর্মীরা। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন দুপুরে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের বলেন, কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে এত বড় অপারেশনের কথা ভাবা যেত না। আপনারা বেশি করে প্রচার করুন। আমাদের চিকিৎসকরা কত বড় অপারেশন করতে পারে, আপনারা দেখান।

দুই শিশুর বাবা মো. রাজু বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, আমার দুই শিশু আমাদের কাছে ফিরে আসবে। আমি তো গরিব মানুষ। ক্ষেতে কাজ করি। কারও কোনো ক্ষতি করি না। খোদাও আমাগো দেখবে।’

অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষায় রয়েছেন দুই শিশুর নানা শহীদুল ইসলাম ও তাদের পাঁচ বছর বয়সী ভাই শাহাদাত। শহীদুল সাংবাদিকদের বলেন, আমার নাতিনদের জন্য দোয়া করবেন। দেশবাসীকে দোয়া করতে বলবেন। শিশু দুটির মা শাহিদা বেগম বলেন, আমার মেয়ে দুটির সফল অপারেশন হয়েছে। এজন্য আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। এছাড়া চিকিৎসকদের প্রতিও রইল আমার কৃতজ্ঞতা।
এমটিনিউজ২৪ডটকম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে