ঢাকা: কে হচ্ছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) নতুন মেয়র? এ নিয়ে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতারা দলীয় প্রার্থিতা নিয়ে নিজেদের মধ্যে প্রাথমিক আলোচনা করছেন। সূত্র জানায়, এ ক্ষেত্রে দলের পছন্দের শীর্ষে রয়েছেন প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হক। আনিসুল হকের একমাত্র ছেলে নাভিদুল হকের নামও আলোচনায় রয়েছে।
বিএনপির নেতারাও এ উপনির্বাচন নিয়ে নিজেদের মধ্যে প্রাথমিক আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন। আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে এ নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতারা। দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের শীর্ষে রয়েছেন। তিনি গত নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় প্রার্থী ছিলেন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তিনি। গত নির্বাচনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচার কার্যক্রম সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন দলের কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান। তিনি জানিয়েছেন, ডিএনসিসির মেয়র পদে উপনির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাই নিয়ে এখনও কোনো আলোচনা হয়নি। তবে কিছুদিনের মধ্যেই এ নিয়ে দলীয় পর্যায়ে আলোচনা শুরু হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল রোববার কম্বোডিয়া সফরে গেছেন। তিনি আগামীকাল মঙ্গলবার দেশে ফিরবেন। এর পরই দলীয় প্রার্থী নিয়ে আলোচনা শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে বলে দলের কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন। তাদের মতে, আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এ উপনির্বাচন সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সকলের চোখ থাকবে এ নির্বাচনের দিকে। সে ক্ষেত্রে যোগ্য প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পেরোতে হবে আওয়ামী লীগকে।
দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করার আগে ঢাকা-১১ আসনের এমপি একেএম রহমতুল্লাহ, ঢাকা-১২ আসনের এমপি আসাদুজ্জামান খান কামাল, ঢাকা-১৩ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, ঢাকা-১৪ আসনের এমপি আসলামুল হক আসলাম, ঢাকা-১৫ আসনের এমপি কামাল আহমেদ মজুমদার, ঢাকা-১৬ আসনের এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ ও ঢাকা-১৮ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের পরামর্শ নেওয়া হবে বলে জানা গেছে। তাদের নির্বাচনী এলাকা ডিএনসিসি আওতাভুক্ত।
এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) সভাপতি ও ঢাকা-৯ আসনের এমপি সাবের হোসেন চৌধুরী, দলের ঢাকা মহানগর উত্তর সভাপতি একেএম রহমতুল্লাহ, ঢাকা-১৫ আসনের এমপি কামাল আহমেদ মজুমদার, নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি ও চিত্রনায়িকা সারাহ বেগম কবরী, দলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান ও মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম কৃক।
সম্ভাব্য প্রার্থিতা নিয়ে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের ছেলে নাভিদুল হক এখনই কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কিছুই বলতে চাননি সাবের হোসেন চৌধুরীও। তবে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে তাকে নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। মেয়র পদে নির্বাচনে লড়তে আগ্রহ রয়েছে একেএম রহমতুল্লাহর। তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতি করি। আগ্রহ তো থাকবেই। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের ওপরই সবকিছু নির্ভর করছে। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’
সারাহ বেগম কবরী গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কবরী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি গত নির্বাচনে প্রার্থী হননি। উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে তার আগ্রহ রয়েছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে তিনি এবারও প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকেই মেনে নেবেন।
সাদেক খান উপনির্বাচনে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। তিনি বলেছেন, তিনি অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনে তিনবার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও দুইবার ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই নেতাকর্মীরা তাকেই মেয়র পদে দেখতে চাইছেন।
মাহমুদা বেগম কৃক বলেছেন, প্রার্থী হওয়ার জন্য দলের নেতাকর্মীদের একটি অংশ তাকে তাগাদা দিচ্ছে। তবে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর তিনি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবেন। তিনি অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনে দু’বার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছিলেন।
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুতে শূন্য পদে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে পদটি শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশের পর ইসি নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে বলেও জানান তিনি।
অংশ নেবে বিএনপি : মেয়রের আসন শূন্য ঘোষণায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন উপনির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি। দলের মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী কে হবেন- এখনই বলতে নারাজ দলটির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করলে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে তারা জানান।
সূত্র জানায়, রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও অংশ নিয়েছে বিএনপি। ঢাকাসহ আরও যে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে, তাতেও অংশ নেওয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি চলছে। সরকারকে বিনা চ্যালঞ্জে ছেড়ে দেবে না বিএনপি। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাকে মেয়র প্রার্থী করা হবে- সে ব্যাপারে এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এ ব্যাপারে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সদস্য ও বিএনপি সমর্থিত বুদ্ধিজীবী-বিশিষ্ট নাগরিকসহ, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবেন খালেদা জিয়া। আলোচনার পরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। তবে উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল গত নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও ভোট জালিয়াতির অভিযোগ এনে মাঝপথে নির্বাচন বর্জন করেন। এবারও মনোনয়ন চাইলে তাবিথ আউয়াল পাবেন বলে মনে করেন দলের একাধিক নেতা।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলো মস্কো থেকে তাবিথ আউয়াল বলেন, বিগত সিটি নির্বাচনে তিনি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী ছিলেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তিনিই বিজয়ী হতেন বলে দাবি তার। আগামী উপনির্বাচনেও দল মনোনয়ন দিলে তিনি নির্বাচন করবেন। বিগত নির্বাচনে তার অবস্থান মূল্যায়ন করে দলীয় হাইকমান্ড তাকেই মনোনয়ন দেবেন বলে আশা তাবিথ আউয়ালের।
এ বিষয়ে আবদুল আউয়াল মিন্টুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, আগামী উপনির্বাচনে আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রার্থী হবেন না। তিনি ছেলে তাবিথ আউয়ালকেই বিএনপির মেয়র প্রার্থী হিসেবে দেখবেন বলে আশা করছেন।
বিগত নির্বাচনে বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরী মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন, বিএনপি হয়তো তাকে সমর্থন দেবে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে মনোনয়ন না দিয়ে তাবিথ আউয়ালকে মনোনয়ন দেয় বিএনপি। এবারের নির্বাচনে কাকে প্রার্থী করা হবে এখনও দলের সিদ্ধান্ত হয়নি। সেক্ষেত্রে মাহী বি. চৌধুরী আবার নির্বাচনে প্রার্থী হবেন কি-না বা প্রার্থী হলেও বিএনপির সমর্থন চাইবেন কি-না, তা নিয়েও দলের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। তবে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ওপরই সবকিছু নির্ভর করছে বলে নেতারা জানান।
সূত্র জানিয়েছে, এবার কোনো কারণে তাবিথ আউয়াল নির্বাচন না করলে বা মনোনয়ন না পেলে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল থেকে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থর কথা চিন্তা করতে পারে বিএনপি। আবার ২০ দলীয় জোটের বাইরে জাতীয় ঐক্যের চিন্তা করে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার নামও চিন্তায় আনতে পারেন বিএনপি হাইকমান্ড। নতুন চমক হিসেবে নাগরিক সমাজের কোনো জনপ্রিয় প্রতিনিধিকেও চিন্তা করতে পারে বিএনপি হাইকমান্ড।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, মাত্র মেয়র আনিসুল হক মৃত্যুবরণ করেছেন। এ বিষয়ে তিনি এখনও কোনো চিন্তা করেননি।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিএনপি প্রায় সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের জন্যও বিএনপি প্রস্তুত। তবে স্থানীয় হোক আর জাতীয় নির্বাচন হোক, সব নির্বাচনই সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ চায় বিএনপি। বিগত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে। যখন দেখা গেছে নির্বাচনে কারচুপি চলছে, তখন নির্বাচন বর্জন করতে বাধ্য হয়েছে। এবার কাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন আনিসুল হক। ওই দায়িত্ব পালনের মধ্যেই চলতি বছরের জুলাইয়ে যুক্তরাজ্যে গিয়ে হাসপাতাল ভর্তি হন সেরিব্রাল ভাস্কুলাইটিসে আক্রান্ত মেয়র। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি গত ৩০ নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।-সমকাল।
এমটিনিউজ২৪/টিটি/পিএস