ঢাকায়: রাজধানীর ডেমরায় সবে স্কুলে যাওয়া শুরু করা শিশু ফারিয়া আক্তার দোলা (৫) ও নুসরাত জাহান (৪) হত্যার কারণ উদ্ঘাটিত হয়েছে। খেলারত ওই দুই শিশুকে লিপস্টিক দিয়ে সাজিয়ে দেওয়ার কথা বলে গোলাম মোস্তফা তার ঘরে নিয়ে যায়। আগেই তার ফুফাতো ভাই আজুিল বাওনিয়াকে ডেকে নিয়ে আসে মোস্তফা। এরপর তারা শিশু দুটিকে ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। শিশুরা চিৎকার করতে শুরু করে। আর চিৎকারের শব্দ যাতে বাইরে না যেতে পারে সে জন্য জোরে গান বাজায় মোস্তফা। ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে তারা শ্বাসরোধে দুই শিশুকে হত্যা করে।
এদিকে রাজধানীর গেণ্ডারিয়া এলাকায় দুই বছরের শিশু আয়েশাকে খিচুড়ি খাওয়ানোর কথা বলে বাসায় ডেকে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা চালায় নাহিদ। পরে সে তিনতলার জানালা দিয়ে শিশুটিকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করে। নাহিদের মেয়ে বুশরা পুলিশকে সহযোগিতা করার কারণে হত্যা রহস্য বেরিয়ে এসেছে। পুলিশ গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে এই দুই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছে।
গতকাল দুপুরে মিন্টো রোডে পুলিশের গণমাধ্যম শাখায় এক সংবাদ সম্মেলনে ওয়ারী বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) ফরিদ উদ্দিন আহমেদ প্রথমে ডেমরায় দুই শিশু হত্যার ঘটনা সম্পর্কে জানান। তিনি বলেন, ডেমরার কোনাপাড়া এলাকার বাড়ি থেকে সোমবার বিকেলে নিখোঁজ হয় দোলা ও নুসরাত। তাদের খোঁজে এলাকায় মাইকিং করা হয়। রাতে কোনাপাড়ার শাহজালাল রোডের মোস্তফার ঘর থেকে দুই শিশুর লাশ উদ্ধার করে এলাকাবাসী। পরদিন মঙ্গলবার রাতে যাত্রাবাড়ীর ভাঙাপ্রেস ও ডেমরার মোল্লাব্রিজ এলাকা থেকে মোস্তফা ও আজিজুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ডিসি ফরিদ উদ্দিন জানান, লাশ উদ্ধারের পর তাঁরা ধারণা করেছিলেন, অত ছোট বাচ্চাদের মুক্তিপণের জন্য হয়তো নেওয়া হয়েছে। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে দুজন বলেছে, ধর্ষণ করার উদ্দেশ্যে তারা নুসরাত আর দোলাকে সোমবার দুপুরে বাসায় নিয়ে যায়। লিপস্টিক দিয়ে সাজিয়ে দেওয়ার নাম করে প্রথমে তাদের বাসায় ডেকে আনা হয়। এরপর আজিজুল ও মোস্তফা ইয়াবা সেবন করে উচ্চশব্দে গান ছাড়ে। পরে ধর্ষণের চেষ্টা করলে শিশুরা চিৎকার শুরু করে। একপর্যায়ে দোলাকে গলাটিপে হত্যা করে আজিজুল এবং নুসরাতকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে মোস্তফা।
হত্যার পর আজিজুল পালিয়ে যায় আর মোস্তফা দুই শিশুর মরদেহ নিয়ে বাসায় থাকে। একপর্যায়ে খাটের নিচে মরদেহ রেখে দেয়। মোস্তফার স্ত্রী গার্মেন্টকর্মী আঁখি সন্ধ্যার দিকে কারখানা থেকে বাসায় ফিরে স্বামীর অস্বাভাবিক আচরণ দেখতে পান। মেঝেতে শিশুদের সেন্ডেল পড়ে থাকতে দেখেন তিনি।
ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘সন্ধ্যায় মোস্তফার স্ত্রী আঁখি বাসায় ফিরে স্বামীর অস্বাভাবিক আচরণ দেখে সন্দিহান হয়ে ওঠেন। আঁখি প্রতিবেশীর বাসায় গেলে ওই ফাঁকে মোস্তফা বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। পরে এলাকাবাসীর সহায়তায় পুলিশ ওই বাসার খাটের নিচ থেকে মেয়ে দুটির লাশ উদ্ধার করে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত গামছা এবং আরো কিছু আলামত উদ্ধার করা হয়। মোস্তফা সিরামিকের কারখানায় ও আজিজুল একটি বেকারিতে কাজ করে বলে জানায়।’
ডিসি বলেন, শিশুরা চিৎকার করলেও উচ্চশব্দে গান বাজানোর কারণে বাইরের কেউ শুনতে পায়নি। শিশু দুটি নার্সারিতে পড়ত। তাদের সাজিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ঘরে ডেকে নেয় মোস্তফা।
ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত কি না জানতে চাইলে ফরিদ উদ্দিন বলেন, মোস্তফা ফোন করে আগেই আজিজুলকে বাসায় ডেকে নেয়। তার মানে বোঝা যাচ্ছে এখানে কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল। তারা একে অপরের মামাতো-ফুফাতো ভাই।
তিনি আরো জানান, পেশায় সিরামিক মিস্ত্রি মোস্তফার বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় ডাকাতিচেষ্টার একটি মামলা রয়েছে। তার গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর, আর আজিজুলের বাড়ি ফরিদপুরে। এ ঘটনায় প্রথমে মোস্তফার স্ত্রী আঁখি ও শ্যালককে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে আয়েশাকে হত্যা করে নাহিদ গেণ্ডারিয়ার সাধনা ঔষধালয়ের পাশে দীননাথ সেন রোডের একটি বাসায় গত শনিবার শিশু আয়েশাকে খিচুড়ি খাওয়ানোর কথা বলে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা চালায় নাহিদ। পরে সে তিনতলার জানালা দিয়ে শিশুটিকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নাহিদের মেয়ে বুশরা আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে।
ডিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ জানান, শনিবার লাশ পাওয়ার পরদিন নিহত আয়েশার বাবা ইদ্রিস আলী বাদী হয়ে ‘ধর্ষণের পর হত্যার’ অভিযোগ এনে প্রতিবেশী নাহিদকে আসামি করে গেণ্ডারিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে মামলার আসামি নাহিদকে গ্রেপ্তার করতে গেলে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে সে নিজ বাসার তৃতীয় তলার খোলা জানালা দিয়ে লাফিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। এতে তার দুই পা ভেঙে যায়। নাহিদ এখন পুলিশ হেফাজতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ফরিদ উদ্দিন জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নাহিদ জানিয়েছে, প্রতিবেশী শিশু আয়েশাকে খিচুড়ি খাওয়ানোর কথা বলে বাসায় ডেকে নেয় সে। পরে শিশুটিকে তিনতলা থেকে ফেলে হত্যা করে। তার থেকে এর বেশি কিছু জানা সম্ভব হয়নি, কারণ সে অনেক বেশি অসুস্থ।’
ডিসি জানান, শিশু আয়েশা হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে এগিয়ে আসে গ্রেপ্তারকৃত আসামি নাহিদের সপ্তম শ্রেণিতে পড়া মেয়ে বুশরা। গত মঙ্গলবার বাবার কুকর্মের কথা তুলে ধরে আদালতে জবানবন্দি দেয় সে। আদালতে বুশরা জানায়, শনিবার সন্ধ্যার দিকে বাসার বারান্দায় বসে ছিল সে। এ সময় বাবার শোবার কক্ষ থেকে শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনতে পায় সে। এরপর সে বাবার কক্ষে যায়। দরজা খুলে দেখে, তার বাবা বিছানায় আর আয়েশা তার কোলে কাঁদছে। তখন নাহিদ বুশরাকে ধমক দিয়ে বলে, ‘এই তুই এখানে এসেছিস কেন?’ তখন বুশরা অন্য রুমে চলে যায়। এরপর নাহিদ আয়েশাকে তিনতলার খোলা জানালা দিয়ে ফেলে দেয়।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি, পাঁচ বছর আগে নাহিদের স্ত্রী মারা যায়। এরপর সে আর বিয়ে করেনি। ১২ বছরের মেয়েকে নিয়ে নাহিদ ওই বাসার তৃতীয় তলায় থাকে। আর গেণ্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডের একটি টিনশেড বাড়িতে বাবা-মা ও বোনদের সঙ্গে থাকত শিশু আয়েশা (২)। প্রতিদিন সকালে আয়েশার মা-বাবা কাজে চলে যেতেন। আর দিনের বিভিন্ন সময় গেণ্ডারিয়ার সাধনা ঔষধালয়ের সামনের গলিতে চারতলা ভবনের সামনে খেলা করত সে।’