নিউজ ডেস্ক : আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে পি'টিয়ে হ'ত্যা করার ভ'য়ঙ্কর বর্ণনা দিয়েছেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সমাজসেবা বিষয়ক উপসম্পাদক ইফতি মোশাররফ ওরফে সকাল।
বৃহস্পতিবার বিকালে মহানগর হাকিম খন্দকার ইয়াসির আহসান চৌধুরীর কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন সকাল। আবরার হ'ত্যার ঘটনায় শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ১৭ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে সকালই প্রথম ব্যক্তি, যিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
জিজ্ঞাসাবাদে সকাল বলেছেন, ৪ অক্টোবর বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিন শের-ই বাংলা হল ছাত্রলীগের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে একটি নির্দেশনা দেন। এতে বলা হয়, আবরার শিবির করে, তাকে ধরতে হবে। এরপর মেসেঞ্জার গ্রুপে সাড়া দেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা। আবরার তখন বাড়িতে থাকায় তিনি ইফতিকে বলেন, ‘ওকে বাড়ি থেকে ফিরতে দেন।’
সকাল আদালতে বলেন, ৬ অক্টোবর (রবিবার) রাত আটটার কিছু পর আবরারকে শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়ে আসা হয়। আবরারের দুটি মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপও সঙ্গে আনা হয়। তার রুমমেট বুয়েট ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ একটি মোবাইল ফোন এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম ওরফে তানভীর আরেকটি মোবাইল ফোন চেক করেন। একই বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মুনতাসির আল জেমি আবরারের কাছ থেকে তার ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড নিয়ে খুলে চেক করেন।
জবানবন্দিতে সকাল জানিয়েছেন, আবরারের ডিভাইসগুলো তারা যখন চেক করছিলেন, তখন মেহেদী হাসান এবং বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক মো. মেফতাহুল ইসলাম ওরফে জিয়ন (নেভাল আর্কিটেকচার মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র) কক্ষে আসেন। মেহেদী তাঁদের বুয়েটে কারা কারা শিবির করে তা আবরারের কাছ থেকে বের করার জন্য নির্দেশ দেন। এ সময় মেহেদী বেশ কয়েকটি চড় মা'রেন আবরারকে।
সকাল আদালতকে বলেন, ওই কক্ষে তখন ক্রিকেটের কোনো স্টাম্প ছিল না। বাইরে থেকে তখন কেউ একজন স্টাম্প নিয়ে আসেন। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সামসুল আরেফিন ওরফে রাফাত স্টাম্প এনে তার হাতে দেন। আবরারের কাছ থেকে কথা বের করার জন্য স্টাম্প দিয়ে চার-পাঁচটি আ'ঘাত করেন ইফতি। এতে স্টাম্পটি ভে'ঙে যায়। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক অনিক সরকার (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র) স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু, পা, পায়ের তালু ও বাহুতে মা'রতে থাকেন। এতে আবরার উল্টাপাল্টা কিছু নাম বলতে শুরু করেন। তখন মেফতাহুল আবরারকে চ'ড় মা'রেন এবং স্টাম্প দিয়ে হাঁটুতে বা'ড়ি দেন। এ সময় মেহেদী মুঠোফোনে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
সকাল আদালতকে বলেন, রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনি ক্যানটিনে খেতে যান। মিনিট বিশেক পর ফিরে এসে দেখেন, আবরার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি মেঝেতে শুয়ে আছেন। তিনি তখন আবরারকে ধমক দিয়ে উঠে দাঁড় করান। কয়েকটি চড় মা'রেন। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মুজাহিদুর রহমান তখন কক্ষে থাকা স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে মা'রেন। ইফতি আবার স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু ও পায়ে আ'ঘাত করেন। তাবাখখারুল তখন চড়-থাপ্পড় মা'রেন।
সকাল ঘটনার বর্ণনা দেয়ার এই পর্যায়ে বলেন, রাত ১১টার দিকে অনিক সরকার আবার কক্ষে আসেন। হঠাৎ অনিক স্টাম্প দিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে এলোপাতাড়ি শতাধিক আ'ঘাত করেন। অনিক খুবই অনিয়ন্ত্রিতভাবে আবরারকে মা'রতে থাকেন। তার মা'রা দেখে সবাই ভয় পেয়ে যান। আনুমানিক রাত ১২টার পর অনিক আবরারকে মা'রা থামিয়ে কক্ষের বাইরে যান।
সকাল বলেছেন, তখন আবরার অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলেন। তিনি জানান, তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তখন আবরারের মাথার নিচে দুটি বালিশ দেন তিনি। এর কিছুক্ষণ পরই আবরার বমি করেন। মুঠোফোনে বিষয়টি অনিককে জানানো হলে তিনি আবরারকে গোসল করিয়ে হাতে-পায়ে মলম লাগিয়ে দিতে বলেন। এ সময় আবরার দ্বিতীয়বার বমি করেন। তখন আবরারের কক্ষ থেকে তর কাপড়চোপড় নিয়ে আসা হয়। তখন মেহেদী আবরারকে দেখে বলেন, ‘ও নাটক করছে’।
সকাল বলেন, এরপর আবরারকে ২০০৫ নম্বর কক্ষে নিয়ে শুইয়ে দেয়া হয়। এ সময় অমিত খুদে বার্তা পাঠালে তিনি সবকিছু জানতে চান এবং আবরারকে আরও মেরে আরও তথ্য বের করতে বলেন। আবরারের অবস্থা খুব খারাপ জানালে অমিত তাকে হল থেকে বের করে দিতে বলেন। এর কিছুক্ষণ পর মেহেদী ও অনিক ২০০৫ নম্বর কক্ষে আসেন। আবরারকে দেখে তারা বলেন, ‘ও ঠিক আছে।’ এরপর তাঁরা চলে যান।
সকাল বলেন, এ সময় আবরার আবার বমি করেন। মেহেদী তখন আবরারকে পুলিশের হাতে দেয়ার জন্য নিচে নামাতে বলেন। ১৭ ব্যাচের ছেলেরা আবরারকে নিচে নামানোর চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হলে তোশকসহ আবরারকে ধরে দোতলা ও নিচতলার সিঁড়িতে নামিয়ে রাখেন। তখন আবরার বলছিলেন যে তার খুব খারাপ লাগছে। সাধারণ সম্পাদক রাসেল তখন নিচে নেমে হলের প্রধান ফটকে পুলিশের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এ সময় মুনতাসির দৌড়ে এসে বলেন, আবরারের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ইফতি তাকে মালিশ করতে বলেন। ইসমাইল ও মনির তখন অ্যাম্বুলেন্সে ফোন দেন। অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি হওয়ায় তামিম বাইক নিয়ে বুয়েট মেডিকেলের চিকিৎসক নিয়ে আসেন। চিকিৎসক আসার পরপরই অ্যাম্বুলেন্স আসে। চিকিৎসক সিঁড়িতে আবরারকে দেখে বলেন, ‘ও মা'রা গেছে।’ পরে ইফতি একটি কক্ষে গিয়ে শুয়ে থাকেন। সেখান থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
হ'ত্যাকা'ণ্ডের ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে সোমবার সন্ধ্যার পর চকবাজার থানায় একটি হ'ত্যা মামলা করেন নিহত আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ্।