বৃহস্পতিবার, ০৩ মার্চ, ২০১৬, ০৬:১২:৩৯

হুমকির মুখে জাবির জীববৈচিত্র্য

হুমকির মুখে জাবির জীববৈচিত্র্য

আরিফুল ইসলাম আরিফ, জাবি প্রতিনিধি: প্রজাপতি, অতিথি পাখি এবং সবুজ প্রাকৃতিক অরণ্যের পরিবেশ এই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।  সবুজ-প্রকৃতিপ্রেমী দর্শনার্থীদের পদচারণায় সারা বছর মুখরিত থাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সবুজের ক্যাম্পাস হিসেবেও দেশব্যাপী সুনাম রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির। প্রায় সাতশো একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবাসিক উচ্চশিক্ষার বিদ্যা নিকেতনে কয়েক দিন আগেও রাস্তায় চলাচলের সময় দেখা যেত গুঁইসাপ, বেজি, গিরগিটি, কাঠ-বিড়ালিসহ নানা ছোট আকৃতির প্রাণির আনাগোনা। রাতে শিয়াল, বাগডাশ, হুতুম ও লক্ষ্মীপেচাঁসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণির হাঁক-ডাক আর চলাচলের শব্দে ছায়ামানব জাবির পরিবেশ গ্রামীণ রাতের আবহে উত্তাল হয়ে উঠতো। কিন্তু সেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে কিছু উশৃঙ্খল শিক্ষার্থী এবং কর্মরত কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর অসচেতনতা, অবহেলা এবং উদাসীনতায়। প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কার করার নামে আগুন দিয়ে পরিবেশ ধ্বংসের ফলে পরিচিত এসব বন্যপ্রাণি হুমকির মুখে। বিপর্যয়ের মুখে ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক পরিবশে ও জীব বৈচিত্র্য।

জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্নতার জন্য কর্মচারীরা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও রাস্তার পাশের ঝোপগুলো কেটে পরিষ্কারের কাজ করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেট অফিসের তত্তা¡বধানে এই কাজ করা হয়। কিন্তু প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুম এলেই ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কারের নামে কর্মচারীরা সেখানে আগুন লাগিয়ে দেন বলে অভিযোগ করেছেন প্রত্যাক্ষদর্শীরা। আর সে আগুন ছড়িয়ে পরে বনাঞ্চলে। এবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-বেরুনী হলের পেছনে, আ ফ ম কামালউদ্দিন হলের খেলার মাঠ সংলগ্ন বনাঞ্চলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনের লেক (অতিথি পাখির বিচরণ ওই লেকে), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের দক্ষিণ পাশের এলাকা, সুইমিং পুল সংলগ্ন এলাকা, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সামনের এলাকা, আল-বেরুনি সম্প্রসারিত হলের পেছনের মাঠ, জহির রায়হান মিলনায়তন সংলগ্ন এলাকায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে ঐসব এলাকায় জীব-বিচিত্র্য হুমকিতে পরেছে। হুমকিতে রয়েছে ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক পরিবেশও।

এদিকে বনাঞ্চলে আগুন এবং সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। বায়োটেকনোলজী এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী আশরাফুজ্জামান বিল্পব বলেন,‘ ক্যামেরা নিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়েছিলাম পাখি ও প্রকৃতির ছবি তুলতে। কিন্তু আমাকে ওখানে গিয়ে এরকম(আগুনে পুড়ে দেওয়ার) দৃশ্য দেখে মর্মাহত হতে হয়েছে। এরকম চলতে থাকলে প্রাকৃতিক সৌন্দরযের লীলাভূমি আমাদের এই সবুজ ক্যাম্পাস হারাবে তার অস্তিত¦, হারাবে তার চিরচেনা রুপ। অতিদ্রুত এই সমস্যার সমাধান করা হোক।’

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিংপুল সংলগ্ন এলাকাটি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সুইমিং পুলের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে চারটি গাছ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে ওই এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। পূর্ব পাশে কিছুদূর হেটে দেখা যায় একটি পাখি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
এদিকে বনাঞ্চলে আগুন দেওয়ার খবর শুনে সুইমিংপুলের এই এলাকা পরিদর্শনে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম। এসময় প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে দ্রুত ব্যাবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
তবে বনাঞ্চল পুড়ে ছাই হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ধ্বংশের মুখে পড়লেও এই বিষয়ে ‘তেমন কিছু’ জানেন না বিশ্ববিদ্যালয় স্টেট অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নুরুল আমিন। গতকাল তিনি বলেন,‘বনজঙ্গল পুড়লে আমি কী করবো। এটি আমাদের কাজ নয়। কোথাও এধরনের কোনো খবর পেলে আমরা যতটুকু পারি চেষ্ঠা করি প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায়। আর তাছাড়া সব সময় আমাদের পক্ষে এগুলো দেখাশুনা করাও সম্ভব নয়।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে চলতে থাকলে আগামি পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েল জীববৈচিত্র্য ধ্বংশের পথে চলে যাবে। ক্যাম্পাসে থাকবে না কোনো অতিথি পাখি কিংবা প্রজাপতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষার জন্য প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ ও ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগকে সাথে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে একটি সমন্বয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এই সমন্বয় কমিটি সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি নীতিমালা তৈরি করবে, তার বাস্তবায়ন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করবে।
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মো. মনোয়ার হোসেন তুহিন  বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববৈচিত্র প্রকৃতি প্রদত্ত। কিন্তু প্রকৃতি প্রদত্ত এই অপরুপ সৌন্দর্য্যকে আমরা হারাচ্ছি আমাদের অসচেতনতা এবং উদসীনতার কারনে। ক্যাম্পাসের বনজঙ্গল পুড়িয়ে দেওয়ার ফলে বন্যপ্রাণিদের আবাসস্থল ও প্রজননক্ষেত্র গুলো নষ্ট হয়েছে। ফলে আগে যেসব বন্যপ্রাণি দেখা যেতো সেসব দিন দিন কমে যাচ্ছে।

প্রজাপতি নিয়ে গবেষণার জন্য পরিচিত শিক্ষক অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন আরও বলেন, বাংলাদেশে মোট ৩০৪ প্রজাতির প্রজাপতির মধ্যে জাবিতেই ১১০ প্রজাতির প্রজাপতি পাওয়া গেছে। দিন দিন এভাবে বনজঙ্গল ধ্বংস করা হলে প্রকৃতির শোভা এসব প্রজাপতির সংখ্যাও কমে যাবে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম গতকাল বলেন,‘বনাঞ্চল পুড়িয়ে দেওয়া এবং আগুন দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আমি মর্মাহত। এবিষয়ে রেজিস্ট্রার সাহেব এবং প্রক্টরিয়াল বডির সাথে কথা বলে নির্দেশনা দিয়েছি। আগামি অনুষ্ঠিতব্য প্রশাসনিক সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো। কে বা কারা আগুন দেয় সে বিষয়ে এখনো কিছু জানতে পারি নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটি নিয়ে কাজ করছে। আশা করছি এটি বন্ধ হবে। তবে সবার আগে আমাদের সবার সচেতনতা বাড়াতে হবে।’
৩ মার্চ,২০১৬/এমটি নিউজ২৪/প্রতিনিধি/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে