রবিবার, ২২ মে, ২০১৬, ০১:০৭:৫১

ক্যাম্পের দিকে আর পা দেয় না ফারজানা

ক্যাম্পের দিকে আর পা দেয় না ফারজানা

রুদ্র মিজান: রাতটি ছিল পবিত্র শবেবরাতের। রাত শেষে ভোরে ঘটেছিল নৃশংস ঘটনা। রাজধানীর মিরপুরের কালশিতে বাইরে তালা দিয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয় ঘরে। দুর্বৃত্তদের আগুনে পুড়ে ও পুলিশের গুলিতে নিহত হন ১০ জন। এই নৃশংস ঘটনার দুই বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জড়িত কেউ গ্রেপ্তার হওয়া তো দূরের কথা, নিহতদের কোনো স্বজন বাদী হয়ে মামলা করারও সুযোগ পাননি। মামলা করতে ইচ্ছে প্রকাশের পর গাড়িচাপায় রহস্যজনকভাবে মারা গেছেন নিহতদের স্বজন মোহাম্মদ ইয়াসিন। তারপর থেকে এ বিষয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না কেউ। হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করা হয়েছিল। চার সপ্তাহের মধ্যে জবাব চেয়েছিলেন আদালত। চার সপ্তাহ থেকে নয় মাস পেরিয়ে যাচ্ছে। তবুও রুলের জবাব দেননি সংশ্লিষ্টরা।


সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কালশি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও নিহতের স্বজন ফারজানাসহ ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ চেয়ে আদালতে রিট করেন বিহারিদের নেতা মোহাম্মদ সাদাকাত খান ফাক্কু। গত বছরের ২৫শে আগস্ট রুল জারি করেন আদালত। এতে জানতে চাওয়া হয়, হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও ক্ষতিগ্রস্তদের কেন ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না? চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। রিট আবেদনের শুনানি শেষে বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের বেঞ্চ এ আদেশ দেন। স্বরাষ্ট্র সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, মিরপুর জোনের ডিসি, ডিবির যুগ্ম কমিশনার, পল্লবী থানার পরিদর্শক (ওসি), পরিদর্শক (তদন্ত)-সহ নয়জনকে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিলো। চার সপ্তাহ পেরিয়ে নয় মাস চলে যাচ্ছে, আদালতের রুলের জবাব দেননি সংশ্লিষ্টরা।


তার আগে হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছেও গিয়েছিলেন নির্যাতিতরা। কিন্তু সুষ্ঠু তদন্ত জোটেনি। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার আদৌ পাবেন কিনা তা নিয়ে সংশয়ে আছেন নির্যাতিতরা। একই পরিবারের ৯ জনকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার পর বেঁচে ছিলেন ওই পরিবারের কর্তা মোহাম্মদ ইয়াসিন ও তার মেয়ে ফারজানা। নির্যাতিতদের অভিযোগ, স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার মদদে ক্যাম্পবাসীকে উচ্ছেদ করার জন্য ২০১৪ সালের ১৪ই জুন কুর্মিটোলা ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ করা হয়। যদিও শবেবরাতের রাতের আতশবাজিকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটে বলে প্রথমে প্রচার করা হয়।


স্থানীয়দের অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে ওই হামলায় স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ অংশগ্রহণ করে। হামলার একটি ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, সামনে ছিল পুলিশ। পেছনে হামলাকারীরা। এ সময় মাইকে ঘোষণা দিলে ক্যাম্পবাসীও প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। তখন দুইপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ছুড়লে ক্যাম্পবাসী পিছু হটে। এ সময় পুলিশের উপস্থিতিতেই কুর্মিটোলা ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ করে হামলাকারীরা। ক্যাম্পের ইয়াসিনের ঘরে তখন ঘুমাচ্ছিলেন তার পরিবারের ১০ সদস্য। ওই ঘরের বাইরে তালা দিয়ে অগ্নিসংযোগ করলে আগুনে পুড়ে মারা যান নয়জন। অগ্নিদগ্ধ হন ফারজানা। ঘরের বাইরে থাকায় বেঁচে যান ইয়াসিন। আগুন নেভাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন প্রতিবেশী আজাদ।


সংশ্লিষ্টরা জানান, ঘটনার পর ক্যাম্পবাসীকে আসামি করেই মামলা করে পুলিশ। এ হত্যাকাণ্ডের পর মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন ইয়াসিন। মহিলা আইনজীবী সমিতির অফিসে আইনজীবী সালমা আলীর সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শও করেন তিনি। এর কয়েক দিন পরে ২০১৪ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর পল্লবী বাসস্ট্যান্ডে বাসচাপায় রহস্যজনকভাবে নিহত হন তিনি। তবে এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলেই মনে করেন কুর্মিটোলা ক্যাম্পবাসী। নিহত ৯ সদস্যের পরিবারের বেঁচে যাওয়া একমাত্র সদস্য ফারজানা। মোহাম্মদপুর রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের সপ্তম শ্রেণির এই ছাত্রী ক্ষোভের সঙ্গে বলে, বিচার চেয়ে কি হবে? আমার বাবা (ইয়াসিন) মামলা করতে চেয়েছিলেন বলেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। যে মামলা করতে চাইবে তাকেই হত্যা করা হবে। এ হত্যাকাণ্ডের আদৌ বিচার হবে কি-না এই কিশোরী তা জানে না।


ফারজানার স্বজনরা জানান, পরিবারের সবাইকে হারিয়ে খালার বাসায় মোহাম্মদপুরে থাকছে সে। তার লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছে একটি উন্নয়ন সংস্থা। কুর্মিটোলা ক্যাম্পের ওদিকে পা দেয় না ফারজানা। স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ফারজানা বলেন, ওদিকে গেলেই মা-বাবা, ভাই-বোনকে মনে পড়ে। পুড়িয়ে মানুষ মারলো কিন্তু আমরা বিচার পাচ্ছি না। ফারজানা জানতে চায়, এই দেশে আমাদের জন্য কী কোনো আইন নেই?


সূত্রমতে, অগ্নিদগ্ধ ফারজানার জন্য ওষুধ কিনতে বাসা থেকে বের হন ইয়াসিন। পল্লবী বাসস্ট্যান্ডে মিরপুর লোকাল সার্ভিসের নয় নম্বর বাস তাকে চাপা দেয়। গাড়ি দেখে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তবু প্রাণে রক্ষা হয়নি। ওই বাসটি যুবলীগ ঢাকা উত্তরের এক নেতার।
উর্দু পিপলস রিহ্যাবিলিটেশন মুভমেন্টের নেতৃবৃন্দ জানান, গত বছরের ৩০শে জুন কালশি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও  বিচার চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে স্মারকলিপি দেন তারা। এ সময় তারা হামলার একটি ভিডিও ফুটেজ দেন মন্ত্রীকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে তৎকালীন পুলিশ কমিশনারকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত হত্যাকারী কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ।

উর্দু পিপলস রিহ্যাবিলিটেশন মুভমেন্টের সভাপতি মোহাম্মদ সাদাকাত খান ফাক্কু বলেন, রহস্যজনকভাবে মন্ত্রীর নির্দেশের পরও জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ভিডিও ফুটেজ সম্পর্কে তিনি জানান, মন্ত্রীর কাছে দেয়া ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যায় কারা ইয়াসিনের ঘরে অগ্নিসংযোগ করছে। তারপরও তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। অবিলম্বে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি। এ বিষয়ে আদালতের রুল জারি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের রিটের প্রেক্ষিতে আদালত রুল জারি করেছিলেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা রুলের জবাব দেননি।
এ বিষয়ে পুলিশের মিরপুর জোনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আদালতের রুলের জবাব দিতে পুলিশের ল’ ইউনিট প্রস্তুতি নিচ্ছে।-এমজমিন

২২ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে