রবিবার, ২৯ মে, ২০১৬, ০১:২০:১০

চ্যালেঞ্জিং জব আমার খুব পছন্দ

চ্যালেঞ্জিং জব আমার খুব পছন্দ

আফরিন আপ্পি: চ্যালেঞ্জিং জব আমার খুব পছন্দ। সবসময়ই চাইতাম এমন কিছু করতে। যেখানে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকবে। হতে হবে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন। আর চাইতাম সুশৃঙ্খল একটা লাইফ। যেখানে নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে জীবনকে এগিয়ে নেয়া যাবে। পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের স্মার্ট চলাচল, পোশাক পরিধানের স্টাইল অনেক বেশি আকৃষ্ট করতো আমাকে। সচ্ছল পরিবারে জন্ম নেয়ায় অর্থের প্রতি লোভ কখনোই ছিল না। আর তাই খুব ভালোভাবইে জানতাম পুলিশ হলেও সৎভাবেই জীবনযাপন করতে পারব। এভাবেই তার প্রকৌশলী পেশা ছেড়ে পুলিশে আসার কথা বলছিলেন হুমায়ুন। পুরো নাম মোমতাজুল এহসান আহাম্মদ হুমায়ুন। ১৯৮১ সালে জন্ম নেয়া এ তরুণ ২৭তম বিসিএসে পুলিশে প্রথম হওয়ার মাধ্যমে যোগ দেন সহকারী পুলিশ কমিশনার পদে। বর্তমানে তিনি পদোন্নতি পেয়ে কর্মরত আছেন পরিবহন বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার হিসেবে। অত্যন্ত মেধাবী এ পুলিশ কর্মকর্তা জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই অর্জন করেছেন সাফল্য।

ঢাকার কলাবাগানের বশিরউদ্দিন রোডের স্থায়ী বাসিন্দা তারা। পিতা-মাতার ৩ সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। পিতা মোনতাজ উদ্দিন আহাম্মদ। পেশায় ছিলেন ব্যবসায়ী। মাতা নূরজাহান বেগম গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী ছিলেন পুলিশের এ কর্মকর্তা। খুব অল্প বয়সেই পড়ে ফেলেন নামিদামি লেখকদের লেখা শত শত বই।  অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়া হুমায়ুন ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখতেন প্রকৌশলী হওয়ার। আর তাই সেই কৈশোরেই স্বপ্ন বুনেছিলেন বুয়েটে (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) পড়ার। সেইমতো নিতে থাকেন প্রস্তুতি। ১৯৯৭ সালে গভ. ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে  এসএসসি ও ১৯৯৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় স্টার মার্কস পাওয়া হুমায়ুনের চোখে মুখে তখন শুধুই বুয়েটে পড়ার স্বপ্ন। ভর্তি পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে পাস করে ভর্তি হন বুয়েটের যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগে।

ক্যাম্পাস জীবনে বন্ধুদের সঙ্গে পার করেন মধুর সময়। সেখানেও অব্যাহত রাখেন ভালো ফলাফলের ধারা। বুয়েটে চতুর্থ বর্ষে পড়াকালীন হঠাৎ করেই পরিবর্তন আসে হুমায়ুনের ভাবনায়। ভাবতে থাকেন এমন একটা চাকরির কথা যেখানে থাকবে অনেক সম্মান। মা ও প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে প্রবাসে যাওয়ার আগ্রহ কখনোই ছিল না তার। আর সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ সম্মানজনক চাকরি  বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দেয়ার। যেই ভাবা সেই কাজ। শুরু করেন জোর প্রস্তুতি। রাতদিন এক করে শুরু করেন পড়াশোনা। প্রথমেই ঠিক করেন লক্ষ্য। প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নেন পুলিশ ক্যাডারকে আর তাই বাল্যকালের অভ্যাসমতোই নির্ধারণ করে ফেলেন পুলিশে প্রথম অথবা দ্বিতীয় তাকে হতেই হবে। সেই মতোই করতে থাকেন পড়াশোনা। বিসিএস প্রিলিমিনারির পাশাপাশি প্রস্তুতি নিতে থাকেন লিখিত পরীক্ষার।

হুমায়ুনের ভাষায়, আমি জানতাম আমি পারব। সেই বিশ্বাসটা মাথায় রেখেই সবসময় পড়াশোনা করতাম। ছোট থেকেই চাইতাম ভুল হোক সঠিক হোক নিজের জীবনের সব সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার। প্রকৌশল পেশা ছেড়ে পুলিশে আসার সিদ্ধান্তটাও একান্তই আমার। ২০০৫ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় ২৭তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ৭ মাস পর অনুষ্ঠিত হয় লিখিত পরীক্ষা। উভয় পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ২০০৬ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হয় মৌখিক পরীক্ষা। মৌখিক পরীক্ষার পরই তিনি যোগ দেন তিতাসে প্রকৌশলী হিসেবে। সেই সঙ্গে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন ফলাফলের। অবশেষে আসে বহু প্রতীক্ষিত ফলাফলের  সেই  দিন। অনেক খুশি হই যখন জানতে পারি আমি পুলিশে প্রথম স্থান অধিকার করেছি। বুঝতে পারি আমি আমার স্বপ্ন পূরণের পথে আরো একধাপ এগিয়ে গেলাম। যেহেতু এটাই আমার প্রথম বিসিএস ছিল সেজন্য  উত্তেজনাটাও ছিল অনেক বেশি।

কিন্তু আনন্দের রেশ কাটতে না কাটতেই নিমজ্জিত হতে হয় হতাশার সাগরে। এর কারণস্বরূপ পুলিশের এ কর্মকর্তা জানান সেই সময় সারা দেশ একটা সংকটকালীন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। সরকার পরিবর্তনের কারণে বাতিল করা হয় ২৭তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল। পরে আবার মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয় এবং  পূর্বে পুলিশে নির্বাচিত প্রায় ১৫০ জন ক্যাডারের মধ্যে রাখা হয় মাত্র ২৭ জনকে। এতজন বাদ পড়লেও হুমায়ুন বাদ পড়েননি বরং দ্বিতীয়বার ভাইবা দিয়েও আগের মতোই প্রথম স্থানের অধিকারী হন। পরবর্তী মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিনটিকেই তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন হিসেবে অভিহিত করেন তিনি। বলেন, সে এক অন্যরকম অনুভূতি। যা বলে বোঝানো যাবে না। মনে হচ্ছিল মাথার ওপর থেকে অনেক বড় একটা বোঝা নেমে গেল। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

সেদিন বিকালে আমার যতজন পরিচিত আছেন সবাইকেই প্রায় ফোন করে জানিয়েছিলাম। সে এক অপরিমেয় আনন্দ। ইঞ্জিনিয়ার থেকে পুলিশ। কেমন লাগে বিষয়টা? প্রশ্ন করতেই হেসে ফেলেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। বলেন, অনেক ইন্টারেস্টিং লাগে বিষয়টা। যতবার ভাবি ততবারই ভাল লাগে। ইঞ্জিনিয়ার থাকাকালীন জীবন ছিল স্থবির। অন্যের অধীনে কাজ করতে হতো। নিজের সিদ্ধান্তের কোন মূল্য ছিল না। আর পুলিশে যোগ দেয়ার পর থেকেই পদে পদে নিতে হয় চ্যালেঞ্জ। খুব ভাল লাগে। যেদিন প্রথম জয়েন করেন সেদিনই হুমায়ুন বুঝতে পারেন নিজের বিচার বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা ভুল হয়নি। স্বাধীনচেতা এ পুলিশ কর্মকর্তা সবসময়ই চাইতেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে। আর তাই প্রথম চাকরিতে যোগদান করেই একসঙ্গে ১৫০০ ফোর্সের দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পেয়ে হন আনন্দিত।

চাকরি করতে গিয়ে কখনো কোন বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রায়ই বিপদের সম্মুখীন হতে হয় তবে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শামীম ওসমান ও আইভি রহমানের মাঝে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল সেখানে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে খুব কঠিন একটা সময় পার করতে হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে গিয়েছিল যে ব্যালট বাক্স ছিনতাই রোধে একসময় জনতার উপর গুলি চালানোর মতো পরিস্থিতি চলে আসছিল। সেই সময়টা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল। সারদার ট্রেনিং পিরিয়ডের কথা বলতেই চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এই অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনারের। শেয়ার করেন ফেলে আসা অনেক স্মৃতি।

প্রথম দেড় মাস ট্রেনিং পিরিয়ডের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে কষ্ট হলেও পরবর্তী সময়গুলো পার করেছেন নিরবচ্ছিন্ন আনন্দের মধ্য দিয়ে, ব্যাচমেটদের সঙ্গে একসঙ্গে থাকা, খাওয়া, পড়াশোনা করা, জন্মদিন পালন, বেড়ানোর স্মৃতিগুলো মনে হলে এখনো ভাল লাগায় সিক্ত হন। আকাশ অনেক পছন্দ এই কর্মকর্তার আর তাই সুযোগ পেলেই চলে যান ছাদে। পরতে পছন্দ করেন নীল ও কাল রঙের পোশাক। প্রিয় মায়ের হাতের ইলিশ মাছ ভুনা, গরুর মাংস ভুনা। আর খিচুড়ি। বাবার হাত ধরে প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিনটি এখনো সমুজ্জ্বল তার স্মৃতিতে। স্কুলের শিক্ষক ও সহপাঠীদের অনেক প্রিয় ছিলেন তিনি। বাবার মৃত্যুকেই জীবনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক মুহূর্ত বলে জানান। তার ১০ বছর বয়সেই তার পিতা তাদের ছেড়ে চলে যান পরপারে। মা-ই তখন হাল ধরেন  সংসারের। শক্ত হাতে সামলাতে থাকেন সবকিছু।

সেজন্য স্নেহময়ী  মাকেই  জীবনের সব সাফল্যের কৃতিত্ব দিতে চান তিনি। জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে তিনি বলেন পুলিশে প্রথম হয়ে ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দেয়ার কথা। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সেজন্য বায়োলজিতে নম্বর প্রাপ্তিতে সবসময়ই সবার থেকে থাকতেন এগিয়ে। বইপ্রেমিক পুলিশের এ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালীন ‘বই পড়ে জান’ (বপজ) শীর্ষক প্রতিযোগিতায় ধানমন্ডি জোনে শ্রেষ্ঠ হয়ে অর্জন করেন প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাসের হাত থেকে তিনি গ্রহণ করেন এ পুরস্কার। ব্যক্তিজীবনে দুই সন্তানের জনক তিনি। বিসিএস পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন টার্গেট ফিক্সড করে এগুতে হবে। টার্গেট ছাড়া বিসিএস কোনোভাবেই সম্ভব নয়। থাকতে হবে ডেডিকেশন। হয়তো একবারে হবে না। বারবার পরীক্ষা দিতে হবে। সেক্ষেত্রে ধৈর্যহারা হলে চলবে না। সবাইকে ধৈর্য নিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে রুটিনমাফিক পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।-এমজমিন

২৯ মে,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে