রুদ্র মিজান: কিশোরীর নাম ফারজানা। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। চোখের সামনেই পরিবারের নয় সদস্যকে পুড়ে মরতে দেখেছে সে। বেঁচে ছিলেন শুধু তার বাবা। কিন্তু ঘটনার কয়েক দিনের মাথায় গাড়িচাপায় বাবার মৃত্যুতে একা হয়ে পড়ে ফারজানা। এরপর থেকে নিঃসঙ্গ ফারজানা বেঁচে আছে অন্যের অনুগ্রহে। সামনে তার অজানা গন্তব্য। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাড়া করে ফিরে প্রতিনিয়ত। ঘটনার পর অনেক আলোচনা-সমালোচনা ছিল। ছিল নানা আশ্বাসের ফুলঝুরি। কিন্তু সব হারানো ফারজানাকে এখন দেখার কেউ নেই। কেউ খুঁজে নেয় না তাকে। ২০১৪ সালের ১৪ই জুন কালশী ট্র্যাজেডির কথা স্মরণ হলে নীরবে কাঁদে এ কিশোরী। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছিলেন তার পিতা ইয়াসিন। শেষ পর্যন্ত রহস্যজনকভাবে গাড়িচাপায় তার মৃত্যু হয়। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মরে মরে বেঁচে আছে ওই পরিবারের একমাত্র সদস্য ফারজানা। মা-বাবা, ভাই, বোন কেউ নেই তার। সবাইকে হারিয়ে কিশোরী ফারজানা আশ্রয় নিয়েছে খালার বাসায়।
পৃথিবীতে সবচেয়ে আপনজনদের হারালেও তার বিচার চায় না এই কিশোরী। এ বিষয়ে ফারজানার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া, বিচার চেয়ে কি হবে? এই দেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান যে কেউ মারা গেলে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হয়। আমি ছাড়া পরিবারের ১০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। উল্টো আমাদের হয়রানি করা হয়েছে। আমরা কার কাছে বিচার চাইবো। কে বিচার করবে? ফারজানা মনে করে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার কখনও হবে না। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে রাজধানীর মিরপুর ছেড়েছে ফারজানা। আশ্রয় নিয়েছে মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোড সংলগ্ন মার্কেট ক্যাম্পে এক খালার বাসায়। মঙ্গলবার ওই বাসায় গেলে কথা হয় তার সঙ্গে। ক্যাম্পের সরু গলি দিয়ে ভেতরের একটি কক্ষে থাকেন ফারজানার খালু আসলামের পরিবার। ঘনবসতি শুধু না। এখানে ছোট ছোট এক একটি কক্ষে থাকেন পুরো পরিবারের সদস্যরা। নয় ফুট বাই ১০ ফুটের কক্ষে আসলামের ছয় সদস্যের পরিবারের সঙ্গে থাকে ফারজানা। একটি খাট, উপরে মাচা ও মেঝেতে ঘুমাতে হয় তাদের। এখানেই খাওয়া-দাওয়া ও লেখাপড়া করতে হয়। ধানমন্ডির একটি সেলুনে কাজ করে এই সংসারের ব্যয় নির্বাহ করেন ফারজানার খালু আসলাম। ২০১৪ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর থেকে আসলামের পরিবারের সঙ্গে রয়েছে সে।
ফারজানা জানায়, যতদিন তার পিতা ইয়াসিন জীবিত ছিলেন ততদিন বিভিন্ন লোকজন সাহায্য সহযোগিতা করেছে। ইয়াসিনের মৃত্যুর পর কেউ খোঁজ নেয় না তার। তার লেখাপড়া যখন প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম তখন তাকে বৃত্তি দিয়েছে ‘ওব্যাট হেলপার্স’ নামক উন্নয়ন সংস্থা। ওই সংস্থার প্রকল্প কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাজু জানান, ফারজানার স্কুলের বেতন, ভর্তি ও পরীক্ষা ফিসহ শিক্ষা উপকরণ দিচ্ছে ওব্যাট হেলপার্স। নতুবা এই মেয়েটি হয়তো লেখাপড়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হতো।
ফারজানা জানায়, ঢাকা প্রেসিডেন্সি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে সে। তার খালু আসলাম গৃহশিক্ষিকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। দিপা নামের ওই গৃহশিক্ষিকা সপ্তাহে পাঁচ-ছয় দিন বিকালে তাকে পড়াতে আসেন। স্কুল ও বাসায় লেখাপড়া, খালার কাজে সহযোগিতা ও টিভি দেখে প্রতিদিনের সময় কাটে তার। ফারজানাকে নিয়ে তার পিতা ইয়াসিনের স্বপ্ন ছিল মেয়েটি একদিন শিক্ষক হবে। পিতার সেই স্বপ্ন লালন করছে ফারজানা। লেখাপড়া করে মানুষ গড়ার কারিগর হতে চায়।
এ বিষয়ে ফারজানা বলে, মানুষ কখনও মানুষকে পুড়িয়ে মারতে পারে না। আমার পরিবারের নয় জনকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। তারা তো মানুষ না। আমি আর কিছু না পারি অন্তত শিক্ষক হয়ে মানুষ গড়তে চাই। ভয়ঙ্কর সেই দিনটির কথা মনে নেই ফারজানার। শুধু আগুন আগুন চিৎকারের কথা মনে পড়ে। তারপর অগ্নিদগ্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল সে। অগ্নিদগ্ধ ফারজানাকে বাঁচাতে যুদ্ধ করছিলেন ইয়াসিন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ফারজানাকে তখন জানতে দেয়া হয়নি যে, তার পিতা ছাড়া পরিবারের আর কেউ বেঁচে নেই। সে জানতো তারাও চিকিৎসাধীন। ২০১৪ সালের আগস্টে হাসপাতাল থেকে মিরপুরে এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেন ইয়াসিন ও ফারজানা। সেখানেই অন্যদের আলোচনা আড়াল থেকে শুনতে পেয়ে জানতে পারে তার মা, ভাই, বোন, ভাবী- কেউ বেঁচে নেই। সেদিন মনে হলো পৃথিবীটা ঘোর অন্ধকার। তখনই কিশোরী মেয়েটির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। ইয়াসিন তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, মাগো, তুই আর আমি ছাড়া আমাদের কেউ নাই। ওরা সবাইকে মেরে ফেলেছে। তোকে নিয়েই আমি বাঁচবো। আমি শুধু তোর আব্বু না, আমি তোর মায়ের আদরও দেব।
ফারজানা জানায়, তারপর বেশি দিন তার পিতাকে বাঁচতে দেয়া হয়নি। ২০১৪ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর সকালে ফারজানার ওষুধ কেনার জন্য বের হন ইয়াসিন। পল্লবী বাসস্ট্যান্ডে বাস চাপায় রহস্যজনকভাবে নিহত হন তিনি। ফারজানা বলে, আব্বু যখন নয় জনকে পুড়িয়ে মারার দায়ে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখনই গাড়িচাপা দিয়ে তাকে হত্যা করা হলো। এই হত্যার বিচার চাইলে তাকে রক্ষা করবে কে? চোখের জল মুছতে মুছতে প্রশ্ন করে ফারজানা। পবিত্র শবেবরাতের রাতে ২০১৪ সালের ১৪ই জুন কালশীর কুর্মিটোলা ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ করা হয়। প্রচার করা হয় রাতে আতশবাজিকে কেন্দ্র করে স্থানীয়রা কালশীর ওই ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ করে। নির্যাতিতদের অভিযোগ স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার মদতে ক্যাম্পবাসীকে উচ্ছেদ করার জন্য পরিকল্পিতভাবে পুলিশের উপস্থিতিতে এই হামলা করা হয়। এতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই ফারজানার মা বেবি বেগম (৪০), বড় বোন সাহানি বেগম (২৪), ভাই আশিক (২৩), ভাবী শিখা (১৯), বোন আফসানা (১৯), রোকসানা (৫), যমজ ভাই লালু (১০), ভুলু (১০) ও সাহানীর দুই বছরের ছেলে মারুফ মারা যায়। অগ্নিদগ্ধ হয় ফারজানা। ঘরের বাইরে থাকার কারণে বেঁচে যান ইয়াসিন।
আগুন নেভাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন প্রতিবেশী আজাদ। ফারজানার শরীর জুড়ে এখনও আগুনের দগ্ধতার চিহ্ন। তার খালু আসলাম জানান, এখনও যন্ত্রণা করে। লাল হয়ে যায় পুরো শরীর। এখনও ফারজানার চিকিৎসা করাতে হয়। এ বিষয়ে উর্দুভাষী ছাত্র আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ইমরান খান বলেন, সকল হত্যাকাণ্ডেরই বিচার হচ্ছে। সমপ্রতি পুলিশের স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। পুরো পুলিশ বাহিনী অপরাধীদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘরে তালা দিয়ে নৃশংসভাবে নয় জনকে পুড়িয়ে মারার দুই বছর হয়ে গেলো আজ পর্যন্ত জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করা হলো না। এর বিচার কি হবে না?-এমজমিন
১৫ জুন,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ