জাকিয়া আহমেদ: এতদিনে তার আসল নাম পরিচয় জানা গেছে।তিনি মরিয়ম নন, তার নাম মানসুরা। বাড়ি বিক্রমপুরে,খোঁজ মিলেছে তার ভাই মিজানের। বাবা-মা মারা গেছেন অনেক আগেই। পরিবারের অমতে বিয়ে করে বাড়ি ছেড়েছিলেন, অসুস্থ হওয়ার পর স্বামী তাকে ছেড়ে গেছেন, আর একমাত্র ভাইও এখন তাকে আর বাড়ি ফিরিয়ে নিতে রাজি নন। পাঁচ বছরের মেয়েকে নিয়ে কোথাও দাঁড়াবার জায়গা নেই তার।
শুক্রবার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, যতোটুকু সুস্থ হওয়ার ততোটুকু হয়েছেন মরিয়ম। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে বছরের পর বছর চিকিৎসাহীন অবস্থায় পড়ে থাকা মরিয়ম এখন কথা বলছেন, মনে রাখতে পারেন অনেক কিছু, ফিরতে চাইছেন বাড়ি, কিন্তু আত্মীয় কিংবা পরিবারের কেউ এখন আর তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে রাজি হচ্ছেন না।
কয়েকবার তাকে হাসপাতাল ছাড়ার জন্য বলা হলেও যাওয়ার জায়গা নেই বলে এখনও তিনি মেয়েকে নিয়ে রয়েছেন হাসপাতালেই। তবে এতদিন মরিয়মের পরিবারের কাউকে না পাওয়া গেলেও অবশেষে সন্ধান মিলেছে তার ভাই মিজানের। যোগাযোগ করা হলে মিজান বলেন,আমার নিজেরই চলে না, দুইডা মানুষরে আমি টানমু কেমনে,আমি ওগোরে আনতে পারুম না।
‘মেয়েকে নিয়ে ৫ বছর ধরে হাসপাতালে আছেন মা, হচ্ছে না চিকিৎসা’ শিরোনামে মরিয়মকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন গনমাধ্যমে প্রকাশ হয়। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে এবং মরিয়ম এবং তার মেয়ের সাহায্যে এগিয়ে আসেন অসংখ্য মানুষ। তার চিকিৎসায় গঠিত হয় মেডিক্যাল বোর্ড এবং বিনামূল্যে তার যাবতীয় চিকিৎসা করায় কর্তৃপক্ষ।
মরিয়মের চিকিৎসক শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. গোবিন্দ চন্দ্র রায় জানান, ‘মরিয়মের মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডের কিছু কিছু জায়গা শুকিয়ে গেছে।দিনে দিনে এই অবস্থা আরও খারাপ হবে, দেশে তো নয়ই, বিদেশেও এর চিকিৎসা নেই।’ মরিয়মকে পুনর্বাসন করা প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন প্রয়োজন তাকে কোনও এক জায়গায় পুনর্বাসন। কিন্তু ওকে যে কোথাও পুনর্বাসন করব সেটা তো আমরা করতে পারছি না। তার এমআরআই করা হয়েছে,কিন্তু সেখানে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু আমরা দেখতে পাইনি।’
ডা.গোবিন্দ বলেন,পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা না করে তো আমরা পুনর্বাসনের বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। লোকমুখে শুনেছি একটা ভাই নাকি আছে, সে মাঝে মাঝে ওদের কাছ থেকে টাকা নিতে আসে,কিন্তু তাকে আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি আরও বলেন,আমাদের এখন আর কিছুই করার নেই,ও আর কিউরেবল নয়। এখন যদি কোথাও নিয়ে পুনর্বাসন করা যায় সেটাই ওর জন্য মঙ্গলজনক।
কারণ,মাঝে মাঝে সুস্থ হবে, আবার যতই দিন যাবে ততই সে বিছানায় পড়বে, আরও খারাপের দিকে যাবে। এরই মধ্যে আমরা সে লক্ষণগুলো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ওর তো কেউ সেভাবে নেই, তাহলে যোগাযোগ কে করবে, কে নিয়ে যাবে, কেইবা সব কিছু দেখাশোনা করবে-আমরা আসলে বিপদে পড়ে গেছি ওকে নিয়ে, বলেন তিনি।
ঈদের আগে নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতাল ছাড়ার কথা বলা হলেও কোথাও যেতে রাজি হননি তিনি। মানবিকতার খাতিরে তাকে আমরা একটি বেড অকুপাই করে এখানে রেখে দিয়েছি, কিন্তু সেটা কতদিন সম্ভব, বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্তব্যরত চিকিৎসক। তিনি আরও বলেন, ওকে এখন কোথাও পুনর্বাসন করা দরকার, পরিবারের কাছে ফেরত পাঠানো দরকার, কারন হাসপাতালে থাকলে সে যতটুকু সুস্থ হয়েছে খুব বেশিদিন সেটা থাকবে না, খুব দ্রুত ওর চেঞ্জ দরকার বলেন তিনি।
মরিয়মের ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘মরিয়ম নন, বোনের নাম মানসুরা। চার বছর আগে তাদের বাবা মারা যান, মা মারা গিয়েছেন তারও আগে। পরিবারের অমতে বিয়ে করে মানসুরা কয়েক বছর আগে ঢাকায় আসেন।তারপর থেকে পরিবারের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই,শুধু জানি মেডিক্যাল ভর্তি আছে।’
কিন্তু আপনার বোনটা অসুস্থ, তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়া যায় না প্রশ্ন করলে মিজান বলেন, ‘আমি ধোলাইপাড়ে স্ক্রাবের (গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশের দোকান) দোকানে কাজ করি, নিজেরই চলে না। বাড়তি দু’জন লোকরে কীভাবে চালাই?’
মরিয়মকে দেখে চলে আসার সময় হাসপাতালের বেডে বসে মরিয়ম (মানসুরা)ডেকে বলেন, ‘আপন ভাই হইয়া নিজের কাছে রাখতে চায়না, স্যারেরা (হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ) এইহানে থাকতে দিতে চায় না, আমি এখন কই যামু।’-বাংলাট্রিবিউন
১৭ জুলাই, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ