নিউজ ডেস্ক: বাড়িটির নাম তাজ মঞ্জিল, তবে এলাকায় বাড়িটি জাহাজ বিল্ডিং নামে পরিচিত। রাজধানী কল্যাণপুরের ৫ নম্বর সড়কের গার্লস হাই স্কুলের পাশের ৫৩ নম্বর বাড়ি এটি। এখানেই গতকাল মঙ্গলবার জঙ্গি আস্তানায় পরিচালিত হয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান। জাহাজ বিল্ডিং নামে পরিচিত সেই ভবন এবং এর আশপাশের বাসিন্দাদের কথায় ফুটে উঠেছে গোলাগুলির মধ্যে গভীর আতঙ্কে রাতযাপনের চিত্র। অভিযান ঘিরে কার্যত অবরুদ্ধ ছিলেন কল্যাণপুরের ৫ নম্বর সড়ক ও এর আশপাশের বাসিন্দারা।
আগের রাত ১২টার পর পরই কল্যাণপুরের ৫ নম্বর সড়কের বাসিন্দারা টের পেয়ে যান কিছু একটা ঘটছে। জাহাজ বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলার ভাড়াটিয়া মোহাম্মদ শাহীন জানালেন এ কথা। 'অপারেশন স্টর্ম-২৬' নামে পরিচালিত ওই অভিযান শেষ হয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর গতকাল বেলা ১১টার দিকে শাহীনের সঙ্গে আলাপ হয় তার চায়ের দোকানে। দোকানটি কল্যাণপুর ৫ নম্বর সড়কের প্রবেশমুখে, মূল রাস্তার পাশে।
সারারাতই শাহীনের সদর রাস্তার পাশের এই চায়ের দোকান খোলা থাকে এবং রাতে তিনি দোকান চালান। সোমবারও সন্ধ্যা থেকে দোকানে ছিলেন। সাধারণত সকালে বাসায় ফিরে যান শাহীন। উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে গতকাল দুপুর পর্যন্ত দোকানে থেকে যেতে হয় তার। অবশ্য মোবাইল ফোনে বারবারই শাহীন কথা বলছিলেন তার বাবা জহুর আলীর সঙ্গে। বাবাকে উদ্ধৃত করে জানান, পুলিশ ভবনের তিনতলা পর্যন্ত ওঠার পর ওপর থেকে হামলা চালায় জঙ্গিরা।
ছাত্রলীগের ওই এলাকার নেতা জাহেদুর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান। ৫ নম্বর সড়কের একটি সংযোগ সড়কে বন্ধুবান্ধব নিয়ে দেখছিলেন পুলিশের চলাচল। অপেক্ষা করছিলেন, কখন নিয়ে যাওয়া হয় লাশগুলো। তিনি জানান, সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে মিরপুর থানা পুলিশ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা মিলে কল্যাণপুরের মেসবাড়িগুলোতে জঙ্গিবিরোধী তল্লাশি করছিলেন।
৬ নম্বর রোড থেকে তল্লাশি শুরু হয়। কয়েকটি মেসে অভিযান চালিয়ে তারা আসেন ৫ নম্বর রোডে। এই রোডে জাহাজ বিল্ডিং নামে খ্যাত বাসায় অভিযান শুরু হলেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এরপর আর জাহেদ ঘটনাস্থলে ছিলেন না। তবে তিনি ছাত্রলীগের ১১ নম্বর ওয়ার্ড শাখার সভাপতি এস এম কিবরিয়া পিয়াসের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।
পরে মোবাইল ফোনে পিয়াসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কল্যাণপুর এলাকায় অনেক মেসবাড়ি রয়েছে। এখানে পুলিশের যেমন নজর রয়েছে, আমরাও সতর্কতা অবলম্বন করে থাকি।
তাই অভিযানে পুলিশকে সঙ্গ দিতে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়েও আমরা ছিলাম। জাহাজ বিল্ডিংয়ে পুলিশ ঢুকলে আমরা বাইরে অবস্থান নিই। পরে শুনতে পাই, ভেতরে কারা যেন 'আল্লাহু আকবর' ধ্বনি দিচ্ছে।
জাহাজ বিল্ডিং থেকে ভেসে আসা ওই ধ্বনি পাড়া-প্রতিবেশীর অনেকেই শুনেছেন। জাহাজ বিল্ডিংয়ের পাশের দুই বাড়ি ৪৮/১ নম্বরের নিরাপত্তাকর্মী কবির হোসেন ও ৫১ নম্বরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভাড়াটে বলেন, রাত ১২টার পর বেশ কয়েকবার আল্লাহু আকবর ধ্বনি শুনেছেন। ৫১ নম্বরের ভাড়াটিয়া বলেন, 'জঙ্গিরা বলছিল, আমরা তো মরবই। তোমাদের সঙ্গে নিয়ে মরব।'
দীন ইসলাম, লিয়াকত হোসেন ও তারিক আহমেদ চৌধুরী নামের তিন যুবক জানালেন, জাহাজ বিল্ডিং থেকে মাত্র কয়েকটা বাড়ি দূরত্বে তারা থাকেন। তারা রাতেই টের পেয়েছেন কিছু একটা ঘটছে। ভয় পেয়ে ঘর থেকে বের হননি। মেঝেতে বিছানা পেতে ঘুম আর তন্দ্রার মাঝে রাত কেটেছে তাদের। সকালে ঘুম ভেঙেছে মুহুর্মুহু গুলির শব্দে।
এই তিন যুবকের একজন লিয়াকত কয়েক মাস আগেও জাহাজ বিল্ডিংয়েই ভাড়া থাকতেন। পরিবেশ ভালো না হওয়ায় অন্য বাসায় চলে যান তিনি। তার মতে, শুধু তিনি একা নন, প্রায় প্রতি মাসেই কেউ না কেউ জাহাজ বিল্ডিং ছেড়ে যান এবং অন্য কেউ এসে শূন্য জায়গা পূরণ করেন। জাহাজ বিল্ডিংয়ে সব সময়ই লাগানো থাকে 'টু-লেট' নোটিশ।
মূলত ব্যাচেলরদের আবাসন হিসেবে পরিচিত জাহাজ বিল্ডিংয়ে বাড়ি ভাড়া পাওয়া খুব সহজ। পরিবেশ ভালো না হওয়া বলতে কী বোঝাতে চাইছেন জিজ্ঞাসা করলে লিয়াকত বলেন, একে তো অনেক পুরনো বিল্ডিং। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও খুবই ঢিলেঢালা। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে গেট।
জাহাজ বিল্ডিংয়ের বর্তমান ভাড়াটে শাহীন ও সাবেক ভাড়াটে লিয়াকত জানায়, ওই বাড়ির প্রতিটি তলায় চারটি করে ইউনিট রয়েছে। ভবনটির দোতলার সব ইউনিট নিয়ে থাকেন বাড়িওয়ালা।
তৃতীয় তলার দুটি ইউনিটে ফ্যামিলি ও একটিতে ব্যাচেলররা আছেন। একটি ইউনিট কিছুদিন ধরে ফাঁকা রয়েছে। চতুর্থ থেকে ষষ্ঠতলা চারটি করে ইউনিটের প্রতিটিই মেস হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়, যার সুযোগে পঞ্চম তলায় গড়ে ওঠে জঙ্গি আস্তানা। এক বছর আগে বগুড়া থেকে বাড়ি ছেড়ে আসা হাসান অভিযানের প্রথম প্রহরে ওই বাড়ি থেকে আহত অবস্থায় আটক হয়। পরে অভিযানে নয়জন নিহত হয়।
জাহাজ বিল্ডিংয়ের ষষ্ঠতলায় তিন রুমের একটি ইউনিটে থাকা নয় তরুণের একজন আল্লামা ইকবাল অনিক। তিনি বলেন, রাত সাড়ে ১২টার দিকে বাসার আশপাশে পুলিশের উপস্থিতি টের পান তারা। পরে বুঝতে পারেন, তাদের ভবনেই অভিযান শুরু হয়েছে। ঘণ্টা দেড়েক পর পুলিশ ওপরে ওঠার চেষ্টা করলে শুরু হয় গোলাগুলি।
অনিক ও তার সঙ্গে থাকা তরুণদের সবাই আতঙ্কে বাসার দরজা ভেতর থেকে আটকে রান্নাঘরে গিয়ে অবস্থান নেন। অনিক বলেন, 'সারাটা রাত আমরা রান্নাঘরে লুকিয়ে ছিলাম। একটু পর পর গুলির শব্দ। খুব ভয় হচ্ছিল। গুলির শব্দে মনে হচ্ছিল আজ আর বাঁচব না।' ঢাকার ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করা অনিকের গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলায়। ওই বাসায় তিনি আছেন গত পাঁচ বছর ধরে।
একসময় একটি অনলাইন পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করেছেন অনিক। ভোরের দিকে অভিযানের সময় গোলাগুলির তীব্রতা বেড়ে গেলে পরিচিত এক সাংবাদিককে এসএমএস করে অনিক বলেন, 'আমরা অভিযানের মধ্যে বাসায় আটকা পড়েছি। আমাদের বাঁচান।'
গতকাল দুপুরের পর অনিকের সঙ্গে আর আলাপ করা যায়নি। পরে বিকেল থেকে বন্ধ পাওয়া যায় তার মোবাইল ফোনটি। পরে জানা যায়, জাহাজ বিল্ডিংয়ের ষষ্ঠ তলায় ভাড়া থাকা সাতজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ নিয়ে গেছে। ওই সাতজনের একজন হলেন আল্লামা ইকবাল অনিক।
ওই সাতজনের মধ্যে দু'জনের স্বজনের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, এই সাতজনকে মিরপুর মডেল থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ নিয়ে পুলিশের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে জাহাজ বিল্ডিং থেকে জঙ্গিদের লাশ নিয়ে যাওয়ার পর বাড়িটির দায়িত্বে থাকা রূপনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ সহিদ আলমের কাছে এ নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এ বাসায় এখন আর কেউ নেই। জিজ্ঞাসাবাদ করতে বাসা থেকে সবাইকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে কোথায় নেওয়া হয়েছে, এ বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা তখন আরও বলেন, সিআইডির ক্রাইম সিন টিম বাসার ভেতরে কাজ করছে। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাসাটি সিলগালা করে রাখা হবে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কাউকে বাসায় ঢুকতে দেওয়া হবে না।
ঘটনাস্থলের পাশের ভবনের এক বাসিন্দা বলেন, পাঁচতলার বারান্দায় কালো পাঞ্জাবি গায়ে তিন তরুণকে দেখেছিলেন তিনি। তারা পুলিশকে উদ্দেশ করে নানা কথা বলছিল। ঘটনাস্থলের পেছনের ভবনের এক বাসিন্দা বলেন, রাত দেড়টার দিকে বাড়িটির বারান্দায় দাঁড়িয়ে কয়েক যুবক উচ্চ স্বরে কথা বলছিল।
দূর থেকেও তাদের কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। নিজেদের আইএস সদস্য দাবি করে তারা পুলিশের উদ্দেশে বলছিল, তাদের সঙ্গে ২০ জন সদস্য আছে, তারা সবাই 'জিহাদ' করছে। এ ছাড়া আরবি-বাংলা মিশিয়ে আরও কিছু বলেছিল তারা।
কল্যাণপুর এলাকার নিরাপত্তাকর্মী কাশেম সাংবাদিকদের জানান, সোমবার রাতে একসঙ্গে অনেক পুলিশের উপস্থিতি লক্ষ্য করেন তিনি। বিষয়টি তার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়নি। পরে তিনি বুঝতে পারেন, বিশেষ কোনো অভিযান পরিচালনা করার জন্য পুলিশ এসেছে। তাদের লক্ষ্য ছিল খুব কাছেই 'জাহাজ বিল্ডিং'।
এ সময় তিনি কয়েকজন ছেলেকে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে তার সামনে দিয়ে পালিয়ে যেতে দেখেন। এক ছেলে তার সামনে গিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করতে থাকে। এ সময় তার পরিচয় জানতে চাইলে সে জানায়, 'সে কাগজ কুড়ায়।' মনিরুজ্জামান নামে এক বাসিন্দা জানান, ভোরে গুলির শব্দে মনে হচ্ছিল যুদ্ধ হচ্ছে। ভোরের আলো ফোটার পরও অনেকে ভয়ে ঘর থেকে বেরোননি।'-সমকাল
২৭ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ