নিউজ ডেস্ক: বাংলাদেশে তখন ঈদুল ফিতরের আগে উৎসবের প্রস্তুতি নিয়েই সবাই ব্যস্ত। ঈদের ছুটির আমেজও শুরু হয়ে গিয়েছিল।অনেকে হয়তো নয়দিনের ছুটিতে নিজ গ্রামের বাড়ি বা দেশের বাইরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
সেদিন ছিল শুক্রবার, ১লা জুলাই।
শুক্রবার রাতে হঠাৎ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেল গুলশানে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশের গোলাগুলি হচ্ছে।
এক রেস্টুরেন্টে সশস্ত্র হামলাকারী ঢুকে বেশ কজনকে জিম্মিও করেছে।
ঘটনাটা আসলে কি, গুজব না আসলেই সত্য এবং ভয়ানক কিছু তা নিশ্চিত হতেও ঘন্টাখানেক সময় চলে গেল।
পরে জানা গেল হামলাকারীরা ওই রেস্টুরেন্টে থাকা বিদেশী নাগরিকসহ বেশ কজনকে যে জিম্মি করেছে।
জিম্মি সংকটের ঘটনায় ১লা জুলাই রাতে সারা পৃথিবীর নজর ছিল ঢাকার অভিজাত গুলশান এলাকায় অবস্থিত হলি আর্টিজান বেকারির দিকে।
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে গত ১লা জুলাই রাতে জঙ্গিরা ২০ জনকে হত্যা করে যাদের ৯ জন ইতালি, ৭ জন জাপানী, ৩ জন বাংলাদেশী এবং ১ জন ভারতীয় নাগরিক। এছাড়া সন্ত্রাসীদের হামলায় দুজন পুলিশও প্রাণ হারায়।
পরে হামলাকারী ৬ জনও কমান্ডো অভিযানে প্রাণ হারায়। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
তারপর থেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলোচনায় চলে আসতে শুরু করে।
প্রশ্ন উঠতে শুরু করে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কিভাবে ধর্মীয় উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
গত এক মাসে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এই তরুণরা বাড়ি পালিয়ে জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে বলে তথ্য আসার পর সরকার নিখোঁজদের তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও সচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছে।
যেই হামলার প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে সেই হামলার রাতে কী ঘটেছিল?
হামলার দিন রাতে পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা হলি আর্টিজান বেকারির সামনে অবস্থান নেয়।
গুলশানে জিম্মি সংকটের ঘটনাক্রম:
রাত ৮টা ৪৫ মিনিট: গুলশান ৭৯ নম্বর সড়কের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা হামলা চালায় বলে জানা যায়।
গুলশানের একজন বাসিন্দা রাশিলা রহিম গোলাগুলির ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলেন টেলিফোনে বিবিসি বাংলাকে।
““আমাকে আমার ড্রাইভার বললেন, আপা আপনি এখন বেরুবেন না, নীচে গোলাগুলি চলছে। তারপর দেখি আমার ড্রয়িং রুমের জানালার কাঁচে ফেটে গেল। তারপর থেকে অনবরত গুলির শব্দ শুনতে পাই। এরপর আমার মেয়ে কান্নাকাটি শুরু করে। আমরা সবাই কান্নাকাটি শুরু করি। কারণ খুবই আতংকজনক একটা পরিস্থিতি।”
রাত নয়টা পাঁচ মিনিট: গুলশান ৭৯ নম্বর সড়কের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গীদের হামলার খবর পায় পুলিশ। গুলশানের পুলিশের এসিস্ট্যান্ট কমিশনার আশরাফুল করিম জানান, খবর পাওয়ার সাথে সাথে গুলশান থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যায়।
রাত ৯টা ২০ মিনিটে ঘটনাস্থলে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান প্রত্যক্ষদর্শীরা। ঢাকার উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হক এসময় টুইট “পুলিশ ইজ সারাউন্ডিং দ্য এরিয়া, গানফায়ার স্টিল অন”।
গুলশানে প্রায় বারো ঘন্টার রক্তাক্ত জিম্মি সংকটের অবসান ঘটে সকালে এক কমান্ডো অভিযানের মাধ্যমে।
রাত সাড়ে ৯টার দিকে গোলাগুলিতে আহত হন বনানী থানার ওসি মোহাম্মদ সালাউদ্দীন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।
রাত ১০ টার দিকে পুলিশ, র্যাব এবং আধা সামরিক বাহিনী বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশের কয়েকশো সদস্য ঘটনাস্থলে গিয়ে অবস্থান নেয়।
গণমাধ্যম কর্মীরাও ৭৯ নং রোডের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান নেন। সেখানে ছিলেন বিবিসির সংবাদদাতা কাদির কল্লোলও।
রাত সোয়া ১১টার দিকে হাসপাতালে মারা যান বনানী থানার ওসি মোহাম্মদ সালাউদ্দীন।
রাত চারটা পর্যন্ত অস্ত্রধারীদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
রাতেই ইসলামিক স্টেট জঙ্গী গোষ্ঠী তাদের বার্তা সংস্থা বলে পরিচিত ‘আমাক’এ গুলশান হামলার দায় স্বীকার করে ২০জন নিহত হবার কথা জানায়।
গুলশানে হামলার পর ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গোষ্ঠী তাদের বার্তা সংস্থা 'আমাক' এ পাঁচ হামলাকারীর ছবি প্রকাশ করে।
গুলশানে উদ্ধার অভিযানের ঘটনাক্রম:
সকাল ৭ টা ৩০ মিনিট: রাতভর গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট সংলগ্ন এলাকা ঘিরে রাখার পর যৌথ সেনা, নৌ, পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ কমান্ডো দল গুলশানে অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়।
৭ টা ৪৫ মিনিট: কমান্ডো বাহিনী অভিযান শুরু করে। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দলের সদস্যরা রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করে। এমময় গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়।
সকাল সোয়া ৮টায় রেস্টুরেন্ট থেকে প্রথম দফায় নারী ও শিশুসহ ৬ জনকে উদ্ধার করা হয়। একজনকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হয়।
৮টা ৫৫ মিনিটে ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয় অভিযানকারীরা। গোয়েন্দা দল ভবনের ভেতর বিস্ফোরকের জন্য তল্লাশি শুরু করে। কিছুক্ষন পরই আলামত সংগ্রহের কাজ শুরু করে গোয়েন্দারা।
৯টা ১৫ মিনিটে অভিযান শেষ হয়। কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে প্রায় ১২ ঘণ্টার রক্তাক্ত জিম্মি সংকটের অবসান হয়।
সকাল ১০ টায় ৪ জন বিদেশীসহ ১৩ জন জীবিত উদ্ধারের খবর জানানো হয়। রেস্টুরেন্টের ভেতরে অজ্ঞাত পাঁচজনের মৃতদেহ পাবার কথা পুলিশ জানায়।
১১টা ৫০ মিনিট: অভিযানে সন্ত্রাসীদের ৬ জন নিহত এবং একজন ধরা পড়েছে বলে নিশ্চিত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে আইএসপিআর থেকে এক সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয় রেস্টুরেন্ট থেকে ২০টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।-বিবিসি
১ আগস্ট ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস