মঙ্গলবার, ০২ আগস্ট, ২০১৬, ০৩:৫৭:৫৩

‘ওকে আর স্কুলে পাঠাবেন না, রাখবো না ওকে’

‘ওকে আর স্কুলে পাঠাবেন না, রাখবো না ওকে’

জাকিয়া আহমেদ: আমি জানি আমার ছেলেটা অটিস্টিক, জানি ওর সমস্যা রয়েছে। বাবা হিসেবে সব জানি আমি, কিন্তু তাই বলে এটাতো মানতে পারছি না যে, ছেলেটাকে লেখাপড়া করতে দেওয়া হবে না, পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবে না। তাই অনেক অপমান সয়েও প্রধান শিক্ষককে অনুরোধ করেছিলাম ছেলেটাকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার অনুমতি দিতে, কিন্তু উনি দেননি।

ছেলেটাকে হাফ ইয়ারলি (ষান্মাসিক) পরীক্ষা থেকে বাদ দিয়ে দিলেন। সবাই যদি এমন আচরণ আমাদের সঙ্গে করে, তাহলে এ সন্তানকে নিয়ে কোথায় যাবো আমরা! হতাশ কণ্ঠে কথাগুলো বললেন পরিমল দাস। যিনি একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কিশোরের বাবা।


ছোটবেলায় চিকিৎসকের পরামর্শেই ছেলেকে মূলধারার স্কুলে ভর্তি করান পরিমল। তিনি জানান, চিকিৎসকেরা অনুপমের ডিজঅ্যাবিলিটিকে খুব মাইল্ড বলেই বলেছিলেন। আমরাও সেটা পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছি। সে এখন অনেক স্বাভাবিক। পরিমল বলেন, ধানমণ্ডি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা এবং নিউ মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা দিয়ে পাস করে। এরপরই তাকে ভর্তি করা হয় মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থিত আদর্শ হাই স্কুলে। সে এখন নবম শ্রেণিতে পড়ছে। কিন্তু গত জুন মাস থেকেই অনুপমকে স্কুলে আর না পাঠাতে বলেন স্কুলটির প্রধান শিক্ষক।


প্রধান শিক্ষক পরিমল দাসকে বলেন, আপনার ছেলে গোলমাল করে, ক্লাসে শিক্ষকদের এমন এমন প্রশ্ন করে যে, তারা উত্তর দিতে পারেন না। আপনার এক ছেলের জন্য ক্লাসের অন্য ছেলেদের ক্ষতি হয়, আপনি ছেলেকে নিয়ে যান। কষ্টের সঙ্গে তিনি বলেন, ১৫ দিন গ্যাপ দিয়ে ছেলেকে আবার স্কুলে নিয়ে যাই, ক্লাস শিক্ষক তখন আমাকে বলেন, এ ছেলেকে রাখা যাবে না, আপনি প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করেন। তার সঙ্গে কথা না বলে আগেই ছেলেকে স্কুলে না পাঠানোর জন্যও বলেন তিনি।


কয়েকদিন পর বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের সংগঠন প্যারেন্টস ফোরাম ফর ডিফারেন্টলি অ্যাবল এর প্রেসিডেন্টে সাজিদা রহমান ড্যানিসহ আর চার/পাঁচজন যাই স্কুলে। সেখানে যাওয়ার পর চূড়ান্ত রকমের অপদস্থ ও অপমানিত হতে হয়েছে আমাকে।


অনুপম দাস বলেন, সেদিন প্রধান শিক্ষককে এতো অনুরোধ করলাম কিন্তু কিছুতেই তাকে নরম করতে পারলাম না। সাজিদা রহমান ড্যানি বলেন, আমাদের দেখে তার রাগ যেন আরও বেড়েছিল। স্কুলের শিক্ষকদের সমস্যা হয়, ৬০ জনের ক্লাসে তাকে আলাদা করে শিক্ষক সময় দিতে পারেন না, ক্লাসে সে বিভিন্ন সমস্যা করে  প্রধান শিক্ষক এসব বলার পর তাকে বলেছিলাম, স্কুলের শিক্ষকদের আমরা ট্রেনিং দেবো, কোনও পারিশ্রমিক ছাড়া, আমাদের দায়িত্বে আপনাদের অন্যান্য ছাত্রছাত্রীকে প্রতিবন্ধিতার ওপর ওরিয়েনটেশন দেবো, যাতে তারা তাদের সহপাঠীকে গ্রহণ করতে পারে।

কিছুতেই কাজ হলো না। আমাদের ওপরের ঝাল... উচ্চস্বরে বাবা-মার ওপরে ঝাড়লেন, অনেক কথা বললেন... অনেক অনুরোধে অনুপমের ক্লাস চালিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করা গেল। কিন্তু এটাও বুঝতে পারছিলাম, যে কোনও ধরনের সুযোগ পেলেই উনি এই অটিস্টিক শিশুটিকে বের করে দিতে দ্বিধা করবেন না। শেষ পর্যন্ত তাই হলো, ছেলেটাকে তারা আবারও বের করে দিলেন, ১৫ দিনের মতো ক্লাস করার পর।

পরিমল দাস বলেন, গত ১৬ জুলাই স্কুলে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা শুরুর সাতদিন আগে স্কুলে গেলে প্রধান শিক্ষক বলেন,ওকে আর স্কুলে পাঠাবেন না, রাখবো না ওকে।’ ‘ছেলেটাকে কেবল পরীক্ষাটা দিতে দেন’, এই অনুনয় করলেও তিনি কোনওভাবেই সে কথা শুনছিলেন না, নানাভাবে আমাকে অপমান করছিলেন।

সাজিদা রহমান ড্যানি আরও বলেন, সামান্য কারণে হেড মাস্টার অনুপমকে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা থেকে বাদ করে দিলেন। আর আমি ফোন করায় মনে হলো তাতে উনি আরও রেগে গেলেন, বললেন দেখি কী করা যায়। কিন্তু পরীক্ষার সময় অনুপমকে পরীক্ষার হলেও ঢুকতে দেননি।

সাজিদা রহমান বলেন, সেদিন ছেলেটি হলের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছে! আর হেড মাস্টার যাচ্ছে তাই ভাবে অনুপমের হাত ধরে থাকা তার বাবাকে অপমান করে যাচ্ছেন। একজন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন সন্তানের বাবা হবার জন্য এই অপমানগুলি ভীষণভাবে গায়ে লাগে। ‘পরে প্রশাসনের শরণাপন্ন হই আমরা’, বলেন সাজিদা রহমান ড্যানি।

পরিমল দাস বলেন, পরীক্ষার হলে ছেলেটাকে ঢুকতে দেয়নি, একথা বাসায় এসে আমি ড্যানি আপাকে জানাই। পরে দুপুর দুইটার দিকে স্কুল থেকে ফোন করে বলা হয়, ছেলেকে নিয়ে এক্ষুণি স্কুলে আসেন, তার পরীক্ষা আমরা নেব। পরবর্তী সময়ে পরীক্ষাগুলো নেওয়া হয়েছে এবং গত ৩০ জুলাই তার সব পরীক্ষা শেষ হয়েছে।

সাজিদা রহামান ড্যানি বলেন, সরকারি আদেশ থাকা সত্ত্বেও একজন সরকারি স্কুলের শিক্ষক কী করে শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখেন ও তার বাবা-মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন তা বুঝে পাই না।

আক্ষেপের সঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের সমাজ এবং ব্যক্তিমানুষ হিসেবে আমরা এখনও আমাদের বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের গ্রহণ করতে পারিনি। বেসরকারি চাকরিজীবী পরিমল দাস বলেন, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর পরিবার যেন এই রকম হয়রানি আর না হয় সে আবেদন জানাই।

প্রধান শিক্ষক যা করেছেন আমার সঙ্গে, এর চেয়ে অমানবিক কাজ আর হয় না। সৌভাগ্যক্রমে আমি এর প্রতিকার পেয়েছি, কিন্তু অনেকেরই সে সুযোগ নেই। মাইল্ড অটিজম আছে এমন শিশুদের মূলধারার স্কুলে পড়ার সুযোগ নিতে গিয়ে যেন আর অপদস্থ হতে না হয়। তারাও মূলধারার লেখাপড়া করার যোগ্যতা রাখে এটা সমাজকে বুঝতে হবে, সচেতন হতে হবে।

অনুপমের বিষয়ে জানতে চাইলে আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খোরশেদ আলম বলেন স্কুলে গিয়ে কথা বলতে। ফোনে কথা বললেই হবে জানালে তিনি পাল্টা  প্রশ্ন করেন কোন অনুপম? নবম শ্রেণির বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু অনুপম দাস, যাকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়নি জানালে তিনি এ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, কোনও অনুপম টনুপম চিনি না, আপনি কাল স্কুলে আসেন, তখন কথা হবে।-বাংলাট্রিবিউন

২ আগস্ট, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে