উদিসা ইসলাম: ‘১ জুলাই জিম্মি হয়ে থাকা ৯ ঘণ্টার সেই ভয়ানক স্মৃতি থেকে এখনও মুক্তি পাইনি। জীবন যেন ওখানেই আটকে আছে। ঘুমোতে গেলেই দম বন্ধ হয়ে আসে। ওইদিন পুরোটা সময় আমরা নিচতলায় কর্মচারীদের টয়লেটে বন্দি ছিলাম।
দীর্ঘসময় আটকে থাকায় কোনও ঘটনাই আসলে আমরা বুঝতে পারিনি। সেখান থেকে বের হয়ে আমরা কেউই বুঝতে পারছিলাম না কাকে বিশ্বাস করব, কে যে আসলে সন্ত্রাসী।’ এভাবে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গি হামলার ঘটনার স্মৃতিচারণ করছিলেন রেস্টুরেন্টটির কর্মী শিশির বৈরাগী।
হামলার দিন চার সহকর্মীর সঙ্গে পালিয়ে বেঁচেছিলেন শিশির। প্রাণে বেঁচে গেলেও সেই রাতের ভয়াবহতা তাকে এখনও তাড়া করে ফেরে। এখনও ওই রাতের দুঃস্বপ্ন দেখেন তিনি। শিশির বলেন, আরেক সহকর্মী এসে আমাদের সঙ্গে আটকে থাকা একজনকে ভোরবেলা টয়লেট থেকে বের করে নিয়ে যান। তার নাম আকাশ। মেইন হলে গিয়ে আকাশ দেখেন কেবল লাশ আর লাশ।
প্রথমে তিনি মনে করেছেন জঙ্গিরা হত্যা করে পালিয়ে গেছে। উল্টো জঙ্গিদেরই জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি, আপনারা কাউকে ধরে রাখলেন না, এত মানুষ হত্যা করে চলে গেল। ‘আমরাইতো মেরেছি’ জবাব শুনে থম মেরে যান তিনি।
সেই ভয়াবহ রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে শিশির বলেন, আমি ভেতরের কিচেনে ছিলাম। আমরা খাবার রেডি করে বাইরে একজন শেফ-এর হাতে দেওয়ার পর তিনি সেটা ওয়েটারদের হাতে তুলে দেন। তেমনই একজনকে হুট করে দৌড় দিতে দেখে আমাদের সন্দেহ হয়। সঙ্গে সঙ্গে আমরা কয়েকজন সামনের দিকে দৌড়ে গিয়ে দেখি, যারা আগেই দৌড়ে সেদিকে গেছেন, তারা পিছিয়ে আসছেন।
তখন আমরা কয়েকজন পেছনের দিকে দৌড়ে গিয়ে একটি টয়লেটে লুকিয়ে পড়ি। শিশির বলেন, আমি মালিককে ফোন করে ঘটনা বলি। এরপর থেকে সারারাত আমরা ৯ জন ওই টয়লেটে ছিলাম। ফোনের সাউন্ড বন্ধ করে, আলো যেন না জলে তাই কাপড়ের নিচে লুকিয়ে ফোন নিয়ে বসেছিলাম।
ওই সময় আমাদের মালিকের সঙ্গে কিছুক্ষণ পরপর কথা হয়েছে। তিনি আমাদের পরামর্শ দেন আমরা যেন যেকোনও উপায়ে শরীর ভিজিয়ে রাখি। বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। তারপরও জঙ্গিরা আমাদের অবস্থান জেনে যায়।
শিশির বলেন, তখনও জানি না কোথায় কী হচ্ছে। এরপর জঙ্গিরা এসে আমাদের একে একে বেরিয়ে আসতে বলে। আমরা দরজা খুলে দেখি দু’জন অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে। কোনওদিন এমনকিছু চোখের সামনে দেখিনি। তারা আমাদের আবারও টয়লেটে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে যায়। আমরা কেউ আমাদের ধর্ম পরিচয় জানানি।
শিশির আরও জানান, সকালে বের হওয়ার জন্য আমাদের এক সহকর্মীকে জঙ্গিরা যখন পাঠিয়েছিল, তখন আমরা চারজন উল্টোদিক দিয়ে পালিয়ে যাই। আর বাকিরা জঙ্গিদের ওদিকে যায়। আমরা পালিয়ে পুলিশের হাতে পড়ি আর ওরা গিয়ে জঙ্গিদের দেখতে পায়।
শিশির বলেন, আমরা বারবার চিৎকার করে বলেছি, আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদের ছেড়ে দাও। আমরা যদি আরেকটু সময় ওই ঘরে থাকতাম, তাহলে ওখানেই দম আটকে মরে যেতাম। সেখানে নিশ্বাস নেওয়ার মতো কোনও সুযোগ ছিল না। আজও সেই দমবন্ধ আমি টের পাই।
আর্টিজানের কর্মচারী সমীর বাড়ৈ বলেন, আমরা কিচেনকর্মীদের নিচতলার ওয়াশরুমে ছিলাম এবং ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকি। আমরা আটকে পড়ার ঘণ্টা দুয়েকের ভেতর অস্ত্রধারী দুই জঙ্গি এসে ডাক দিয়ে বলে, বাঙালি ভাইদের কোনও ভয় নেই। আমরা ওয়াশরুম থেকে মাথা নিচু করে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসার পরপরই আবার ঢুকে পড়ার নির্দেশ দেয় জঙ্গিরা। এরপর তারা বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে চলে যায়।
এই দুঃসহ স্মৃতি ভুলে শিশির-সমীরসহ আর্টিজানের অন্য কর্মচারীরা চান নতুন করে জীবন শুরু করতে। বেকার জীবনে তারা এখনও আশা করছেন মালিক নতুন করে কিছু শুরু করলে তাদের ডাক আসবে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় বাড়ির মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন ঠিকই, কিন্তু রোজ রাতের দুঃস্বপ্ন তাদের নিঃশ্বাস ১ জুলাইয়ের মতোই বন্ধ করে দেয়।-বাংলাট্রিবিউন
২ আগস্ট, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ