দিনাজপুর থেকে : দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ৯ নম্বর মঙ্গলপুর ইউনিয়নের উত্তর বিষ্ণপুর গ্রামে মাটির বাড়ি, ওপরে টিনের চালা আর খড়ের ছাউনি, পাটকাঠি দিয়ে বাড়ির সীমানা ঘেরা।
সেই বেড়ার ফাঁক দিয়ে পুলিশ সুপারের মিষ্টি কণ্ঠে ডাক- ‘সুষ্মিতা আপনি বাড়িতে আছেন? আমি দিনাজপুরের পুলিশ সুপার আপনাকে শুভেচ্ছা জানানোসহ মিষ্টি মুখ করাতে এসেছি। আপনি পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীকে গর্বিত করেছেন।’
আকস্মিক এ ডাক শুনে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন সদ্য পুলিশে চাকরি পাওয়া সুষ্মিতা দেব শর্মা ও তার মা মমতা রানী দেব শর্মাসহ পরিবারে সদস্যরা। শরীরে চিমটি কেটে তন্দ্রা কেটে দেখলেন সত্যি সত্যি বাড়ির সামনে মিষ্টি হাতে দিনাজপুরের পুলিশ সুপার সৈয়দ আবু সায়েম।
বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ সুপার নিজ হাতে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে মিষ্টি মুখ করালেন সুষ্মিতাকে। শুনলেন পরিবারের সদস্যদের জীবন-সংগ্রামের কথা। সাহস দিলেন সামনে এগিয়ে যাওয়ার।
এ সময় দিনাজপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) সুশান্ত সরকার, বিরল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ টি এম গোলাম রসুল, কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বজলুর রশীদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সুষ্মিতার বাড়ি দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ৯ নম্বর মঙ্গলপুর ইউনিয়নের উত্তর বিষ্ণপুর গ্রামে। দরিদ্র ঘরের মেয়ে সুষ্মিতার বাবা মনতোষ দেবশর্মা এক বছর আগে পরলোকগমন করেন। মা মমতা রানী দেবশর্মা গৃহিণী।
দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে মেজো সুষ্মিতা। তিনি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের অনার্স ১ম বর্ষের ছাত্রী। স্বপ্ন ছিল বিসিএস করে অফিসার পদে চাকরি করার। কিন্তু সংসারের অভাব-অনটন আর ভাইদের পড়ালেখা তার সেই স্বপ্নকে আপাতত আটকে দিয়েছে।
পরিবারের অভাব অনটনের কথা বিবেচনা করে যে কোনো একটা চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। গত ৩ জুলাই দিনাজপুর পুলিশ লাইন্স মাঠে ট্রেইনি রিক্রুটিং কনস্টেবল পদে চাকরির জন্য লাইনে দাঁড়ান সুষ্মিতা এবং মনোনীত হন।
পুলিশে চাকরি পাওয়া সুষ্মিতা দেব শর্মা বলেন, সবাই জানে বর্তমানে টাকা ছাড়া সরকারি চাকরি পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু আমাকে একটি টাকাও অবৈধ লেনদেন করতে হয়নি। বাবা না থাকায় চাকরির আবেদন, পুলিশ লাইন্সের মাঠে দাঁড়ানো, লিখিত ও অন্যান্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সম্পূর্ণ কাজ একাই করতে হয়েছে।
কিন্তু একা গিয়েও কাঙ্ক্ষিত ১০৩ টাকার আবেদন ফরমের মাধ্যমে চাকরি পেয়েছি। এ জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতি চির কৃতজ্ঞ। তাই চাকরি জীবনে আমি কোনো ধরনের অবৈধ লেনদেন বা অবৈধ টাকা আয় করবো না।
সুষ্মিতার মা মমতা রানী জানান, সুষ্মিতার পড়ালেখার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ আগে থেকেই। সে পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও বিদ্যালয় জীবনে সফল ছিল। তাই কোনো ধরনের অর্থ বিনিময় ছাড়াই নিজ যোগ্যতা ও পুলিশ সুপারের সততায় সে চাকরিটি পেয়েছে।
মঙ্গলপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সেরাজুল ইসলাম জানান, অভাবের সংসারে স্বামীর অবর্তমানে মেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিলেন সুষ্মিতার মা। আজ সুষ্মিতা সম্মানজনকভাবে মেধা ও যোগ্যতার মাধ্যমে পুলিশে চাকরি পেয়েছে।
ইউপি সদস্য আম্পা রানী দেব শর্মা জানান, পুলিশের চাকরি যে টাকা ছাড়াই পাওয়া যায় তার অন্যতম উদাহরণ সুষ্মিতা। এবার দিনাজপুর জেলায় সুষ্মিতার মতো অন্যরাও পুলিশে চাকরি পেয়েছে।