রবিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:৪২:৩৪

‘যমের হাতে চাবি তুলে দিয়েছিলাম’

‘যমের হাতে চাবি তুলে দিয়েছিলাম’

রুদ্র মিজান : ‘যমের হাতে চাবি তুলে দিয়েছিলাম। বুঝতেই পারিনি এই লোকটি একজন কিলার। আমার মাকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে সে।’ কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন শারমিন আক্তার শোভা। শোভার দেয়া চাবি দিয়েই কেচি গেটের তালা খুলে ভাড়া নেয়ার নাম করে বাড়িতে ঢোকে আলোচিত সিরিয়াল কিলার।

এরপর নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছিল শোভার মা ওয়াহিদা আক্তার সীমা (৪৪)কে। গত ৭ই সেপ্টেম্বর বিকালে ঘটনাটি ঘটে। ঘটনাস্থল ঢাকার দক্ষিণখানের আশকোনার গাওয়াইর দক্ষিণপাড়ার ৭১৫ নম্বর বাড়ির ষষ্ঠ তলা। মায়ের ক্ষত-বিক্ষত লাশের কথা স্মরণ হলে এখনো ঘুমের ঘোরে আঁতকে উঠেন শোভা। শুক্রবার ওই বাড়িতে গেলে কথা হয় নিহতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। আশকোনার মেডিকেল রোডের সরু গলি দিয়ে ভেতরে বাড়িটি। বাড়ির মালিক সোহরাব মজুমদার থাকেন কাতারে।

চাকরি করেন কাতার এয়ারওয়েজে। ঘটনার মাত্র তিনদিন আগে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। ঘটনার দিন বিশ্ববিদ্যালয় পুড়য়া দুই ছেলে সোহেল ও শুভ্রকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লাতে ছিলেন সোহরাব মজুমদার। বাসায় তখন সোহরাব মজুমদারের স্ত্রী ওয়াহিদা আক্তার সীমা ও তাদের মেয়ে শোভা। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শোভা কিছুক্ষণ আগে বাসায় ফিরেছেন। তখন বিকাল ৫টা প্রায়।

হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ। শব্দ শুনে বারান্দায় যান শোভা। দেখতে পান এক যুবক দাঁড়িয়ে। দেখতে পুরোদস্তুর ভদ্রলোক। পরনে শার্ট, প্যান্ট, জুতা। কাঁধে ব্যাগ। শোভা জানতে চেয়েছিলেন, কে? জবাবে ভদ্রবেশী ওই যুবক জিজ্ঞাসা করেছিলো, ফ্ল্যাট খালি আছে? খালি আছে জানানোর পর সে জানতে চেয়েছিলো, দেখা যাবে কি-না। শোভা বলেছিলেন, দাঁড়ান, জানাচ্ছি।

তারপর বেডরুমে থাকা মা ওয়াহিদা আক্তার সীমার কাছে বিষয়টি জানালে তিনি বলেছিলেন, ঠিক আছে আসতে দাও। তৃতীয় তলার বারান্দা থেকে কেচি গেটের চাবি নিচে ফেলেছিলেন। ওই চাবি দিয়ে তালা খুলে তাকে উপরে যেতে বলেছিলেন শোভা। নিজ হাতে তালা খুলে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গিয়েছিলো সে। ওয়াহিদা আক্তার সীমা বাসা থেকে বের হয়ে তাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ষষ্ঠ তলায় যান। তারপর কি ঘটেছিলো... তার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই। ষষ্ঠ তলায় যাওয়ার আগে ফোনে কথা হয়েছিলো স্বামী সোহরাব মজুমদারের সঙ্গে। ওই কথাই ছিল স্বামী-স্ত্রীর শেষ কথা।

শোভা জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মা ওয়াহিদা আক্তার সীমাকে না দেখে তিনি ভেবেছিলেন ফ্ল্যাট দেখানোর পর নিচে নেমে হাঁটছেন অথবা পাশের বাসায় গেছেন। কিন্তু ষষ্ঠ তলাসহ নিজেরা যে ফ্ল্যাটে থাকেন ওই চাবিও মায়ের কাছে। যে কারণে দরজা লক না করে বের হতেও পারছিলেন না তিনি।
শোভা জানান, পাশে তার চাচাদের বাসা। ওই বাসায় প্রায়ই যান। ফোনে কথা বলেন চাচীর সঙ্গে। না, সেখানে যাননি তিনি। আবারো অপেক্ষা করেন। না, মায়ের আর ফেরা হয় না। ষষ্ঠ তলায় দু’টি ফ্ল্যাট।

একটি খালি হয়েছিলো আগস্টে। ওই ফ্ল্যাটটি দেখাতেই যান ওয়াহিদা আক্তার সীমা। স্বামী-স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে পাশের ফ্ল্যাটে ছোট একটি পরিবার থাকতো। ঘটনার পর আতঙ্কে বাসা ছেড়েছেন তারা।
ঘটনার দিন বিকাল ৫টা থেকে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ওই পরিবারের কেউ বাসায় ছিলেন না। স্বামী ছিলেন কর্মস্থলে ও শিশু সন্তানকে নিয়ে স্ত্রী ছিলেন একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে।

সর্বশেষ ওই নারীর ফোনে কল করেন শোভা। তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন ষষ্ঠ তলার দরজা লক করা কি-না। ওই নারী তার নিজের বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জানিয়েছিলেন, দরজাটা খোলা তবে একটু চাপানো। কথাটি শুনে কেন যেন বুকটা কেঁপে ওঠে তার। দরজা খোলা রেখেই ষষ্ঠ তলায় ছুটে যান। চাপানো দরজায় ধাক্কা দিতেই জীবনের সবচেয়ে নির্মম দৃশ্যটি দেখেন তিনি। চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন শোভা।

পাগলের মতো মায়ের মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। আশেপাশের লোকজন জানান, আম্মু আম্মু বলে চিৎকার করছিলেন শোভা। ফোনে পাশের বাসার চাচাদের বিষয়টি জানান। শোভা বলেন, পুরো রুমের মেজে রক্তে ভেসে গিয়েছিলো। আম্মুর মাথার পেছনে ও সামনে অনেকগুলো কোপ। মগজ বের হয়ে গেছে। ‘এতো নৃশংসভাবে আমার আম্মুকে মেরেছে। এভাবে মানুষ কোনো মানুষকে মারতে পারে না। আমার আম্মু তো কোনো অপরাধ করেনি। তাকে এভাবে কেন হত্যা করা হলো। এই জীবনে আমিতো আর আম্মুকে পাবো না...’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন শোভা।

পাশের বাড়ির বাসিন্দা শোভার চাচা জিয়াউল হক মজুমদার জানান, শোভার কল পেয়েই দৌড়ে ছুটে যান তারা। সীমাকে নিয়ে ছুটে যান উত্তরার একটি বেসরকারি মেডিকেলে, পরে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার পর যে ভিডিও ফুটেজগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে তা দেখে কিলারকে শনাক্ত করেছেন শোভা। তিনি জানান, ওই ব্যক্তিই ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে সেদিন তাদের বাড়িতে গিয়েছিলো।

এ বিষয়ে সোহরাব মজুমদার বাদী হয়ে দক্ষিণখান থানায় হত্যা মামলা করেছেন। সোহরাব মজুমদার জানান, তিনি এখনো আতঙ্কে আছেন। বাড়িতে তার দুই ছেলে ও মেয়ে থাকে। তাদের জন্য সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকেন তিনি। তাদের কোনো শত্রু নেই। কেন, কি কারণে তার স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে এ বিষয়ে তিনি কোনো ধারণা করতে পারছেন না।

সোহরাব মজুমদারের ভাই জিয়াউল হক মজুমদার বলেন, একই ব্যক্তি একের পর এক হামলা ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আজও তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এ রকম হামলা হলে আমরা কি করব, বাড়িতে তো সবসময় পুরুষ মানুষ থাকে না। তিনি জানান, আগে তাদের বাড়িতে সিসি ক্যামেরা ছিল না। এই ঘটনার পর বাড়িতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেছেন। তিনি বলেন, কিলারের ফুটেজ তো পুলিশ পেয়েছে তারপরও তো তাকে গ্রেপ্তার করতে পারছে না।

এ বিষয়ে দক্ষিণখান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ রোকনুজ্জামান বলেন, পুরো এলাকা পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে। সেইসঙ্গে লোকজনকে মাইকিং ও মিটিং করে এ বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। কেউ বাড়ি ভাড়া নিতে এলে পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে বাসায় ঢুকতে যেন না দেয়া হয়। পরিচয় নিশ্চিত হয়ে বাসায় ঢুকতে দিলেও অন্তত দুইজন পুরুষ মানুষ যেন থাকেন।

তাছাড়া, কোনো প্রকার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। শেখ রোকনুজ্জামান জানান, সীমাকে হত্যার খবর পেয়ে দ্রুত পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। সেখান থেকে একটি লোহার চাপাতি জব্দ করা হয়েছে। ওই সিরিয়াল কিলারকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশ সব ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানান তিনি। এমজমিন

২২ অক্টোবর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে