শুক্রবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৬, ০৮:০৭:৫৬

‘বুড়িমার চকলেট বোম’, কে এই ফরিদপুরের মেয়ে বুড়িমা?

‘বুড়িমার চকলেট বোম’, কে এই ফরিদপুরের মেয়ে বুড়িমা?

এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : তিনি সবার বুড়িমা। বাবারও বুড়িমা, ছেলেরও বুড়িমা। আসলে বুড়িমার চকলেট বোম না হলে তো বাপ-ব্যাটা কারও কালীপুজোই জমত না। ডেসিবেলে বাজি মাপার আগে এই বঙ্গে তো বুড়িমাই শব্দবাজির সাম্রাজ্য চালাতেন।

সে একটা দিন ছিল বুড়িমার। এক পুজো থেকে আর এক পুজো বারো মাসই চাপ আর চাপ। তবে লক্ষ্মীপুজোর পরে চাঁদ যত ছোট হয়ে আসত তত দম ফেলার ফুরসৎ থাকত না তার। ডজন, ডজন বাজি চাই। শুধুই কালীপুজো নাকি! ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচেও তো ‘বুড়িমা’-ই গর্জে উঠে।

এই সর্বজনীন বুড়িমার আসল নাম অন্নপূর্ণা দাস। জন্ম বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়। দেশভাগে ভিটেছাড়া করে নিয়ে আসে পূর্বতন পশ্চিম দিনাজপুর জেলার ধলদিঘি সরকারি ক্যাম্পে।

উদ্বাস্তুদের পার্মানেন্ট লায়াবিলিটি ক্যাম্প থেকে হাওড়া জেলার বেলুড়ে পার্মানেন্ট ঠিকানা হওয়ার মাঝে ছিল অনেক লড়াই। হ্যাঁ, সেই গরিব ঘরের লড়াকু মেয়েই পরবর্তী জীবনে সফল ব্যবসায়ী ‘বুড়িমা।’

স্বামী সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় পূর্ব পাকিস্তানে থাকার সময়েই। তার পরেই বর্তমার বাংলাদেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেন তিন মেয়ে এক ছেলের মা অন্নপূর্ণা। তিনি  ১৯৪৮ সালে ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে ভারতে আসেন। অর্থাভাব কিংবা সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে রিফিউজি ক্যাম্পে চলে আসার গ্লানি তাকে হারাতে তো পারেইনি, উল্টে আরও লড়াকু করে তোলে। ধলদিঘির বাজারে রাস্তায় উচ্ছে, ঝিঙে, পটল, মুলো বিক্রি করে সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছেন অন্নপূর্ণা।

ধলদিঘি থেকে এক সময়ে গঙ্গারামপুরে চলে যান অন্নপূর্ণা। তার আগে তিনি কিছুদিন বিড়ি বাঁধার কাজ করতেন। আর সেই কাজ করতে করতেই শুরু করে দেন বিড়ির ব্যবসা। একদিন সত্যিই স্বপ্নের মতো তার নিজের বিড়ি কারখানা গড়ে ওঠে।

কিন্তু বেশিদিন সেখানেও থাকা হয়নি। মেয়ের বিয়ে দিলেন হাওড়ার বেলুড়ে। সেই সূত্রে বেলুড়ের প্যারিমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে একটা দোকান-সহ বাড়িও কিনলেন। এবার ব্যবসাও বাড়ল। বিড়ির সঙ্গে যুক্ত হয় আলতা, সিঁদুরের ব্যবসা। শুধু কি তাই! বিশ্বকর্মা পুজায় ঘুড়ি, দোলের রং, কালীপুজোর বাজি এমন ছোটখাটো নানা ব্যবসাই শুরু করেন। তবে তখন নিজে তৈরি করতেন না, অন্যের থেকে কিনে এনে বিক্রি করতেন।

ততদিনে তিনি রীতিমতো বুড়ি হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ব্যবসা করার ক্ষেত্রে তার উৎসাহ তারুণ্যকে হার মানাবে। এই সময়েই নাকি তার দোকানে এসে অনেকে অন্নপূর্ণাদেবীকে ‘বুড়িমা’ বলে সম্বোধন করতেন। আর তার পরেই কেমন করে যেন তিনি সবার ‘বুড়িমা’ হয়ে যেতে থাকেন।  

এক সময়ে অন্নপূর্ণাদেবী দেখলেন বাজি কিনে বিক্রির থেকে অনেক বেশি লাভ বাজি তৈরি করে বিক্রি করতে পারলে। সরকারি নিয়ম মেনে শুরু করেন বাজি কারখানা। বিভিন্ন জায়গা থেকে নিজেই খোঁজ করে নিয়ে আসেন বাজির কারিগরদের। নিজের নতুন নামেই তৈরি করলেন ব্র্যান্ড।

‘বুড়িমা’ হয়ে উঠল বাজির জগতে এক বিখ্যাত নাম। ব্যবসা বাড়তে লাগল। এক সময়ে ছেলে সুধীরনাথও যুক্ত হলেন মায়ের ব্যবসায়ে। তত দিনে তিনি নানা রকমের আতসবাজি বানানো শুরু করেছেন, কিন্তু বিখ্যাত হয়ে যায় ‘বুড়িমার চকলেট বোম।’

এর পরেও থমকে যাননি বুড়িমা মানে অন্নপূর্ণা দেবী। অন্ধ্রপ্রদেশের শিবকাশীতে একটি দেশলাই কারখানা তৈরি করেন। এই রাজ্যে ডানকুনিতে চলতে থাকে তার বাজির কারখানা। ব্যবসায় আসেন নাতিরাও।

এখন শব্দবাজি নিয়ে অনেক কঠোর প্রশাসন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার শব্দবাজির তীব্রতা নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। কিছুটা হলেও থমকে যায় ‘বুড়িমা’-র চাহিদা। কিন্তু সেই দিন দেখতে হয়নি অন্নপূর্ণদেবীকে। কারণ, তার ঠিক আগের বছরেই চোখ বুজেছেন তিনি। বাঙালি মেয়ে হিসেবে ব্যবসায় সাফল্যের এক অনন্য নজির গড়েছেন অন্নপূর্ণা দাস। তৈরি করেছেন এক সত্যিকারের রূপকথা। এবেলা

২৮ অক্টোবর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি‌ ‌‌

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে