বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৬, ০১:০২:৫৫

রাজধানীর বুকে এ এক অন্য দুনিয়া

রাজধানীর বুকে এ এক অন্য দুনিয়া

রুদ্র মিজান : অন্ধকারে লেজার লাইটের ঝলকানি। উচ্চস্বরে একের পর এক বাজছে হিন্দি ও ইংরেজি পপ গান। যান্ত্রিক শহরের নানা ব্যস্ততা শেষে দু’দণ্ড আনন্দের জন্যই এখানে সমবেত হয়েছেন যুব থেকে মধ্য বয়সীরা। অনুষ্ঠান শুরুর আগে কারো কারো বিমর্ষতা চোখে পড়ে। কিন্তু ডিজেরা সেই সুযোগ বেশিক্ষণ দেন না।

গানের তালে যখন কেঁপে উঠে চার দেয়াল, মেঝে। তরুণীদের নাচ মুগ্ধ করে দর্শকদের। মনোমুগ্ধকর গানে-নাচে গোমড়া হয়ে বসে থাকার উপায় নেই। একসময় উপস্থিত সবাই মেতে উঠেন আনন্দ উল্লাসে। নাচতে থাকেন নারী-পুরুষ সবাই। কেউ কেউ (প্রচার অযোগ্য শব্দ) পান করে নাচে মাতাল হয়ে যান।

তবে সবাই মত্ত থাকেন আনন্দে। এ এক অন্য দুনিয়া। ডিজে পার্টি নামে পরিচিত। এরকম পার্টি হচ্ছে দেশের অভিজাত বিভিন্নস্থানে। যারা এরকম আনন্দ দেন তারা ডিস্ক জকি বা ডিজে। তাদের মধ্যে অন্যতম মারিয়া আহমেদ, নাঈমা হোসেন পরী, সাদিয়া ইসলাম শান্তা ও সামান্তা।

মারিয়া, পরী, সাদিয়া সবাই মনে করেন, বাজাতে শিখতে হবে। এককথায় হাতের জাদু দরকার। তেমনি দরকার রূপের জাদু। দর্শককে আকৃষ্ট করতে হবে। পোশাক, চাহনি সবকিছুতেই গ্লামার থাকা চাই। অনেক সময় ডিজে পার্টিতে হাতের জাদুর বাইরেও ঘটে নানা ঘটনা। নাচের জন্য থাকেন সুদর্শনা মেয়েরা। যারা অনেক সময় অন্তরঙ্গ সময় দেন নির্দিষ্ট দর্শককে। তবে তারা প্রকৃত ডিজে না বলেই মনে করেন পেশাদার ডিজেরা।

ডিজে মারিয়া বললেন, ডিজে হিসেবে একজন নারী ৩৫ বছর পর্যন্ত ভালো করতে পারেন। বয়সের সঙ্গে কাজের সম্পর্কের বিষয়ে তার সরল জবাব, গ্ল্যামারের ব্যাপার আছে। হাজার হাজার মানুষের মন ভালো করে দেয়ার জন্য মিউজিকের সঙ্গে সুন্দর লাবণ্যময়, আকর্ষণীয় চেহারার প্রয়োজন আছে। সমবেতরা তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। মুহূর্তের মধ্যে সবাইকে আনন্দে ভাসাতে হবে। এটি চাট্টিখানি কথা না।

তিনি বলেন, র‌্যাম্পে ৪১ বছর বয়সী কোনো মডেলকে দেখতে চায় না কেউ। চেহারায় আকর্ষণ থাকতে হবে। বুড়ো বয়সে তা সম্ভব না। পার্শ্ববর্তী দেশের অনেক বয়সী নারীরা সমানতালে পারছেন, আপনারা কেন না? জবাবে মিষ্টি হাসেন মারিয়া। বলেন, তখন ডিজে হিসেবে থাকতে হলে আমাকে প্লাস্টিক সার্জারি করাতে হতে পারে।

মডেলিং ও অভিনয় দিয়ে শুরু মারিয়ার। ২০০৪ সালে পূরবী জুয়েলার্সের মডেল হন তিনি। মডেল হিসেবে পরিচিতি গড়ে উঠে তখন থেকেই। একসময় ব্যস্ত হয়ে যান র‌্যাম্প মডেলিংয়ে। এরমধ্যে টিভি নাটকেও অভিনয় করেছেন। ২০০৯ সাল থেকে ডিজে হিসেবে পথচলা শুরু তার। ডিজে হলেন কেন? জবাবে মারিয়া বলেন, সহজ কথা এই পেশায় আয় বেশি। অন্য কোনো জব করলে এতোটা আর্ন করা সম্ভব হতো না হয়তো। তাছাড়া, এই পেশাকে আমি ভালোবাসি। আমি যখন বাজাতে যাই তখন হাজার হাজার দর্শক ‘মারিয়া মারিয়া’ বলে চিৎকার করে উল্লাস করে। অনেকে ছবি তোলে, অটোগ্রাফ নেয়। এসবই ভালো লাগে। এ এক অন্যরকম ফিলিংস। যা বুঝানো যাবে না। ডিজে পার্টি সবচেয়ে বেশি হয় শীতের মৌসুমে।

মারিয়া জানান, শীতের মৌসুমের অনেক মাসে ৩০ থেকে ৪০টি পার্টিতে অংশ নিতে হয়েছে তাকে।
নিজের শুরুটা সম্পর্কে মারিয়া জানান, তখন দেশে কোনো নারী ডিজে ছিল না। ডিজে রাহাতের গ্যারেজ নামক প্রতিষ্ঠানে ছেলেরা শিখতেন। সময়টা ২০০৭ সাল। বন্ধু জিসানের মাধ্যমে ডিজে রাহাতের সঙ্গে পরিচয়।

রাহাত জানান, দেশে নারী ডিজে দরকার। তিনি এগিয়ে গেলে খুব ভালো। তখন মডেলিং ও অভিনয় করতেন মারিয়া। শখের বশেই ভর্তি হন ডিজে রাহাতের ধানমন্ডির ওই প্রতিষ্ঠানে। একই সঙ্গে শিখছিলেন ডিজে সনিকা। ছয় মাসের ওই কোর্স শেষ করলেও কোনো পার্টিতে অংশ নিতে পারছিলেন না। বাবা-মা চান না তাদের মেয়ে ডিস্ক জকি হিসেবে কাজ করুক। ২০০৯ সালে প্রথম শো করার সুযোগ পান। তা সম্ভব হয়েছিলো চাচাতো ভাইয়ের কারণে। চাচাতো ভাই গুলশানে একটি পার্টির আয়োজন করেন। সেখানে বাজান মারিয়া। জীবনের প্রথম শো থেকে পেয়েছিলেন ১০ হাজার টাকা।

ডিজে মারিয়া হিসেবে পরিচিতি বাড়তে থাকে আরো পরে। সুযোগ হয়েছিল তার বরের কারণে। ডিজে রাহাতের প্রতিষ্ঠানে শিখতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিলো ডিজে জোবায়ের রিশানের সঙ্গে। কয়েক বছর প্রেম করার পর পারিবারিকভাবে ২০১০ সালে বিয়ে করেন তারা। তারপর থেকে এ পথে বাধাহীন তিনি। বরং স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ির উৎসাহে কাজ করে যাচ্ছেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে লালমাটিয়ায় পরিচালনা করছেন ডিজে তৈরির প্রতিষ্ঠান শিপিনিং হাউজ। এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠান থেকে অর্ধশতাধিক ডিজে তৈরি হয়েছে।

১৯৮৭ সালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জন্ম হয় মারিয়ার। গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মাহতাব উদ্দিন ও মমতাজ বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। স্বামী জোবায়ের রিশান ও শিশু সন্তান জাকওয়ার জেন মাহাদকে নিয়ে থাকছেন কল্যাণপুরে। ছেলে ও সংসার নিয়ে স্বপ্ন দেখেন মারিয়া। ছেলে একদিন আর্মি অফিসার হবে। তিনি ডিজেদের স্কুল পরিচালনা করবেন। গোমড়া মুখে বসে থাকা মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর জনসম্পদ তৈরি করতে চান তিনি।

ডিজেদের মধ্যে এক নামেই পরিচিত পরী। তিনি বাজান না শুধু নাচানও। নিজে নাচেন, সঙ্গে দর্শকরা। দেশে-বিদেশে নানা পার্টিতে অংশ নিচ্ছেন তিনি। রাতভর অনুষ্ঠান মাতিয়েও রাখেন পরী। নামে যেমন তেমনি দেখতেও পরীর মতোই আকর্ষণীয়। ডানাকাটা এই পরীর হাতের জাদুতে আচ্ছন্ন হন আনন্দপিয়াসীরা। জাদু আছে চোখে, মুখেও।

নিজের সম্পর্কে পরী জানান, তার নাম মূলত রিপা। মা-বাবা দিয়েছিলেন এই নাম। বিদ্যালয়ে পাঠের শুরুতেই পাল্টে যায় তার নাম। সহপাঠীরা ব্যঙ্গ করে নাম উল্টে দেন। রিপা হয়ে যায় পারি। এই পারি থেকেই তিনি এখন পরী। ডিজে পরী হিসেবেই এখন পরিচিত। পুরো নাম নাঈমা হোসেন পরী।

ডিজে হিসেবে তার শুরু ২০১১ সালের থার্টি ফার্স্ট নাইটে। পাঁচ তারকা হোটেল রেডিসনে একটি পার্টিতে অংশ নেন তিনি। এভাবে একের পর এক পার্টিতে অংশ নিয়েছেন তিনি। দেশে-বিদেশে সহস্রাধিক অনুষ্ঠানে বাজিয়েছেন এই ডিজে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার মেয়ে পরীর পিতা এসএম মোশাররফ হোসেন। মা আফরোজা। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি। পরিবারের সঙ্গে থাকেন যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায়।

পরী দেশে ছাড়াও থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে পার্টিতে অংশ নিচ্ছেন। মডেল হিসেবেও রয়েছে তার পরিচিতি। ২০১২ সালে টেলিকম কোম্পানি রবি’র বিজ্ঞাপনে মডেল হয়েছেন তিনি। এছাড়াও ভেনাস জুয়েলার্স ও অঞ্জন’স-এর মডেল হয়েছেন পরী। তবে ডিজে তার পেশা। ডিস্ক জকির কাজ ছাড়া লেখাপড়াও করছেন তিনি। সিটি কলেজের মার্কেটিং বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন এই ডিজে।

স্বপ্ন ছিল সংগীত শিল্পী হবেন। আর মা-বাবা চেয়েছিলেন মেয়ে হবে আইনজীবী। তা না, একটি পার্টিতে ডিজেদের আঙ্গুলের জাদু দেখে ডিজে হওয়ার প্রবল ইচ্ছে জন্ম হলো। পার্টিতে অংশ নিতে গিয়ে অনেক মজার ঘটনা যেমন ঘটে, তেমনি অনেক বিড়ম্বনারও। গত থার্টি ফার্স্ট নাইটে ধানমন্ডি ক্লাবে বাজাতে বাজাতে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে নাচছিলেন পরী। নাচতে নাচতেই প্রস্তাবটা দিয়ে দিলেন এক তরুণ সংগীত শিল্পী।

প্রথম বাক্যেই জানতে চাইলেন ‘উইল ইউ মেরি মি?’ এমন অবস্থায় পড়তে হয় প্রায়ই। প্রেম, বন্ধুত্ব, বিয়ের প্রস্তাব বাদ যায় না কিছুই। সবকিছুই সহজভাবে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়। পরী বলেন, দর্শকদের আনন্দ দিতে হয়। নাচাতে হয়। এ জন্য নিজে অনেক সময় তাদের সঙ্গে নাচেন। একজন ডিজের যেমন আঙ্গুলের জাদু (বাজানোর দক্ষতা) থাকতে হয় তেমনি রূপের জাদুও থাকতে হয়। তার পোশাকে, চেহারায় আকর্ষণ থাকতে হবে। একইভাবে দর্শকরা কি চায় তা বুঝতে হবে। তবেই সফলতা আসবে বলে মনে করেন তিনি।

অভিন্ন কথা বলেন ডিজে সাদিয়া ইসলাম শান্তা। তিনি বলেন, এই ক্ষেত্রে লুক এবং মুভমেন্টের ব্যাপার গুরুত্বপূর্ণ। তাই গ্লামার ধরে রাখতে চান তিনি। ২০০৭ থেকে বাজাচ্ছেন বিভিন্ন পার্টিতে। কমার্শিয়াল কর্পোরেট সব ধরনের পার্টিতেই রয়েছে তার বিচরণ। শুধু বাজাতেই সীমাবদ্ধ না। বাজান এবং নাচেন। শান্তা বলেন, ছেলে ডিজেরা বাজালে দর্শকরা অনেক সময় নিষ্প্রাণ থাকেন। মেয়ে ডিজে দেখলেই উল্লসিত হন। মেয়ে ডিজেদের কদর বেশি বলেই মনে করেন এই ডিজে। এ জন্য বিব্রতকর অবস্থায়ও পড়তে হয়। অনেক সময় বাজাতে জানেন না শুধু নাচ ও নিজের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে মাতিয়ে রাখেন পার্টি এমন নামধারী ডিজেদের সংখ্যাও কম না বলে জানান শান্তা।

শান্তা বলেন, তরুণদের নানা কথা হজম করতে হয়। পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হয় কৌশলে। সবই নিজের উপর নির্ভর করে। ক্যাটওয়াক শো করতেন শান্তা। সেখানে ডিজে সনিকাকে দেখে ডিজে হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। বাবা তৈয়বুর ইসলাম ও মা নাজু। মা নেই। ওয়ারীতে মামা-মামীর কাছে থাকেন তিনি। গ্রামের বাড়ি সাভার, নবীনগরে।

মারিয়া, পরী, শান্তার মতোই অভিন্ন মন্তব্য সামান্তা খান সানজিদার। ডিজে, মডেলিং ও অভিনয়ে পারদর্শী ইংরেজি মাধ্যমের এই ছাত্রী মনে করেন, ওয়েস্টার্ন এই সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই পোশাক ও লুক থাকা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। দর্শকরা অনেক সময় ডিজের সঙ্গে নাচতে চায় কিন্তু তাদের সব আবদার মেটানো সম্ভব না। এমজমিন

১৬ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে