রবিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৬, ০৭:২৩:১৩

সেদিন কাস্ত্রোর গলায় ঝাঁঝালো বক্তৃতা শুনতে চেয়েছিলাম

সেদিন কাস্ত্রোর গলায় ঝাঁঝালো বক্তৃতা শুনতে চেয়েছিলাম

রজত রায় : ১৯৯৫-এর অক্টোবরের শেষ দিক৷ মাত্র চার বছর আগে বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে গিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ জাতিসংঘের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে নিউ ইয়র্কে হাজির ২০০-র বেশি রাষ্ট্রপ্রধান৷ এসেছিলেন ফিদেল কাস্ত্রোও৷

কিন্ত্ত তিনি শহরে এসে পৌঁছনোর আগেই নিউ ইয়র্কের দক্ষিণপন্থী মেয়র রুডি গিউলিয়ানি ঘোষণা করেছিলেন কাস্ত্রো এলে তাকে জেলে পোরা উচিত৷ ম্যানহাটনে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের কাছে বড় বড় হোটেলগুলিতে উঠেছিলেন সমস্ত রাষ্ট্রপ্রধান৷ কিন্ত্ত সে সব হোটেলে জায়গা দেওয়া হয়নি কিউবার প্রেসিডেন্টকে৷ জাতিসংঘে কিউবার দূতাবাসে ঠাঁই হয়েছিল কাস্ত্রোর৷

মনে আছে, অধিবেশন শুরু আগের দিন রবিবার নিউ ইয়র্কের টাউন হলে সমস্ত রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মানে বিরাট ব্যাঙ্কোয়েটের আয়োজন করেছিলেন গিউলিয়ানি৷ কিন্ত্ত সেখানেও আমন্ত্রণ পাননি কাস্ত্রো৷ পরের দিন, সোমবার সকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের বক্তৃতা দিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন৷ মোট ১৭ মিনিট সময় বরাদ্দ ছিল তার জন্য৷

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজরের ছিল ১০ মিনিট সময় আর কাস্ত্রোর জন্য বরাদ্দ ছিল সাত মিনিট৷ মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে সমস্ত রাষ্ট্রনায়কদের নিয়ে ফটোশুট৷ সেই এলাহি আয়োজনে একেবারে সামনের সারির মাঝের তিনটি আসন রাখা ছিল বিশেষ তিনজনের জন্য৷

মাঝে ক্লিনটন , তার একপাশে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলত্‍‌সিন আর অন্যপাশে জন মেজর৷ ঠান্ডা যুদ্ধের পর বদলে যাওয়া বিশ্বের নতুন সেই ছবিতেও কাস্ত্রো ছিলেন অনেক পিছনের সারিতে৷ ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় চার দশক ধরে চলা ঠান্ডা যুদ্ধেরও অবসান হয়েছে৷ জাতিসংঘের এই বিশেষ অধিবেশনকে বদলে যাওয়া বিশ্বের বিজ্ঞাপন হিসেবে আঁকড়ে ধরেছিল পশ্চিমী দুনিয়া৷ সেই কথাই শোনা গিয়েছিল ক্লিনটনের উদ্বোধনী বক্তৃতায়৷

কাস্ত্রোর উপস্থিতিতেই সদর্পে তিনি বলেছিলেন, ‘ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ৷ এই গোলার্ধে এখন একটাই দেশ আমাদের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলছে না৷ যত দ্রুত সম্ভব তাকে আমাদের পথেই আসতে হবে৷ না হলে ..৷’ জবাবে কী বলবেন কাস্ত্রো ? এর আগে যতবার তার বক্তৃতা টিভিতে শুনেছি তাতে ছিল আগুনের তাপ৷ জলপাই রঙের সেনা উর্দি, কোমরের হোলস্টারে গোঁজা রিভলভার , মাথায় বারান্দাওয়ালা টুপি =, মুখে তার বিখ্যাত চুরুট আর কণ্ঠে তীব্র ঝাঁজ৷

কিন্ত্ত জাতিসংঘে কাস্ত্রো এলেন ডার্ক নেভি ব্লু স্যুটে৷ চুলদাড়ি পরিপাটি আঁচড়ানো৷ বিপ্লবী কাস্ত্রোকে দেখে মনে হচ্ছিল একজন কেরিয়ার ডিপ্লোম্যাট৷ কাস্ত্রো বলছেন স্প্যানিশে৷ কানে হেডফোনে শোনা যাচ্ছে তার ইংরেজি তর্জমা৷ বারবার কান থেকে হেডফোন খুলে ওর গলাটা শুনতে চাইছিলাম আমি৷ কিন্ত্ত কোথায় সেই দুনিয়া কাঁপানো আগুনে কণ্ঠ! অত্যন্ত শান্ত , সংযত , ধীরকণ্ঠে তিনি বলছেন নিজের কথা৷ কয়েক দশক ধরে আমেরিকা ও পশ্চিম দুনিয়ার অর্থনৈতিক অবরোধে কিউবার দুর্দশার কথা৷

যে স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য সারা দুনিয়ার নজর কেড়েছিল কিউবা , সেই দেশে কী ভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের অভাবে হাজার হাজার শিশুর মৃত্যু হচ্ছে , তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে কাস্ত্রো বলছিলেন সে কথা৷ বলছিলেন , এই দীর্ঘ আর্থিক অবরোধ কী ভাবে ‘নিঃশব্দে পরমাণু বিস্ফোরণের’ মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তার দেশকে৷ সারা দুনিয়াকে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখানো ফিদেল সেদিন এমন ভাবে দেখা দিলেন কেন ? উত্তরটা ছিল সমকালের রাজনীতিতে৷ আমেরিকা ও পশ্চিমী দুনিয়ার ঘোষিত অর্থনৈতিক অবরোধে কাস্ত্রোর পাশে দাঁড়িয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন৷

কিউবা থেকে আমদানি করা চিনি বহু বছর ধরে কিনে নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এই ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রটিকে বহু মূল্যবান রসদ জুগিয়ে এসেছে বেশ কয়েক দশক৷ কিন্ত্ত ১৯৯৫ সালে ইয়েলত্সিনের রাশিয়া সে পথে হাঁটেনি৷ সোভিয়েতের পতনের পর আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া কিউবার আর্থিক ও সামাজিক দুর্দশার কথা তুলে ধরে সারা বিশ্বের মনোযোগ টেনে নেওয়া ছাড়া অন্য পথ ছিল না রাষ্ট্রনায়ক কাস্ত্রোর৷ কিন্ত্ত এর পরের দিনই নিউ ইয়র্কের হিস্প্যানিক, আফ্রিকান-আমেরিকানদের জমায়েতে চেনা ফিদেলকে খুঁজে পেয়েছিলাম৷

সেই চেনা সামরিক উর্দি, গলায় সেই ঝাঁঝালো বক্তৃতা৷ জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সামনে কড়া নিরাপত্তার বেষ্টনী পেরিয়ে কাস্ত্রো-বিরোধী বিক্ষোভ দেখিয়ে গেলেন একদল মানুষ৷ মার্কিন মিডিয়া ফলাও করে সে খবর দেখিয়েছিল৷ কিন্ত্ত সে দিনই কাস্ত্রোপন্থী বিক্ষোভকারীদের ম্যানহাটনের আশেপাশে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি, সেটাও নিজের চোখেই দেখা৷ পরে যখন কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলায় গিয়েছি, অবাক হয়ে দেখেছি কী ভাবে গোটা মহাদেশের রোল মডেল হয়ে উঠেছেন কাস্ত্রো৷

কলম্বিয়ার বিখ্যাত কাগজ ‘লা টেম্পায়’ দীর্ঘদিন কাজ করেছিলেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ৷ সেই কাগজে প্রথম পাতায় কাস্ত্রোর ছবি-সহ লিড খবর৷ কোথায় কিউবার কোন শহরে তিনি বক্তৃতা করছেন৷ কেন কাস্ত্রোর এত গুরুত্ব? কলম্বিয়ার এক সাংবাদিক দিয়েছিলেন উত্তরটা৷ ‘কাস্ত্রো ইজ দ্য স্পিরিট অফ লাতিন আমেরিকা৷’ ১৯৫৯ সালে বন্ধু চে গুয়েভারার সঙ্গে তার বিপ্লব রূপকথায় পরিণত হয়েছে৷

তার পর আটলান্টিক দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে৷ বিপ্লবের স্বপ্ন সফল হলেও কিউবার দারিদ্র্য দূর হয়নি , আর্থিক অবরোধে থমকে গিয়েছে বৃদ্ধির পথ, একদলীয় শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ কিউবা ছেড়ে ডিঙি নৌকো নিয়ে ভেসে গিয়েছে আমেরিকার দিকে৷ বিরোধীদের মুখ বন্ধ করা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে কাস্ত্রোর সরকারের দিকেও৷ কিন্ত্ত কাস্ত্রোর ইমেজ তাতে টাল খায়নি৷

পাঁচের দশক থেকেই লাতিন আমেরিকার দেশগুলি হয়ে উঠেছিল মার্কিন পুঁজিবাদ বিস্তারের মৃগয়াক্ষেত্র৷ পুতুল সরকারগুলিকে নিজেদের পকেটে রেখে মার্কিন পুঁজির একতরফা সাম্রাজ্য বিস্তারের পথে প্রথমবার দেওয়াল তুলে দিতে পেরেছিলেন কাস্ত্রো৷ তার সেই বিদ্রোহী ভাবমূর্তিকেই আজীবন সম্মান করেছে গোটা লাতিন আমেরিকা৷ ইউরোপ, এশিয়া থেকে কমিউনিজম বিদায় নিলেও লাতিন আমেরিকায় নতুন ভাবে জন্ম হয়েছে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের৷

তাঁর দেখানো পথেই ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল, গুয়াতেমালা, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়ায় ক্ষমতায় এসেছেন একের পর এক বামপন্থী নেতা৷ চে ও কাস্ত্রোর বিপ্লবের স্বপ্নকে সার্থক করতে গিয়ে প্রচুর দাম দিয়েছে কিউবা৷ কিন্ত্ত শেষ পর্যন্ত সেই স্বপ্ন সফল হয়নি৷ কাস্ত্রো সফল বিপ্লবী, কিন্ত্ত রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি সেই উচ্চতায় পৌঁছতে পারেনি৷ ইতিহাসও তাকে হয়তো সাদা-কালোতেই মনে রাখবে৷ ইন্ডিয়া টাইমস

২৭ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে