বুধবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৭, ০৬:৩৯:৩৮

৮ ব্যক্তির বিপরীতে ৩৬০ কোটি মানুষ!

৮ ব্যক্তির বিপরীতে ৩৬০ কোটি মানুষ!

মশিউল আলম : পৃথিবী এখন ৭৫০ কোটি মানুষের আবাস। কিন্তু এই বিপুল জনসংখ্যা, যা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাড়ছে এবং বাড়ছে মূলত দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ অঞ্চলগুলোতে, তা যে প্রকৃতপক্ষে সম্পদ নয় বরং গভীর এক বিপদ, তা নিয়ে আজ আর কোনো মতভেদ নেই।

২০১৩ সালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে বলা হয়েছিল ‘জনসংখ্যা বিস্ফোরণ’। সেই বিস্ফোরণ অব্যাহত গতিতে ঘটে চলেছে। জাতিসংঘের ভবিষ্যদ্বাণী হলো: পৃথিবীর জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, সেই হার অব্যাহত থাকলে এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ মোট জনসংখ্যা ১ হাজার ১০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। তখন মানুষের অনেক সমস্যা জটিল সংকটের রূপ ধারণ করবে।

প্রথমত, খাদ্যনিরাপত্তা বিরাট ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ১ হাজার ১০০ কোটি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনের সামর্থ্য পৃথিবী নামক গ্রহটির তখনো সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষিত হবে না। কিন্তু সব দেশের ও সব শ্রেণির মানুষের জন্য সেই খাদ্য সহজলভ্য হবে না। বরং এখন পৃথিবীতে যত মানুষ খাদ্যসংকটে ভুগছে, তার তুলনায় অনেক বেশিসংখ্যক মানুষের খাদ্যপ্রাপ্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

বস্তুত, পৃথিবীর পশ্চাৎপদ অঞ্চলগুলোর অধিকাংশ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র মানুষের প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাবার সংগ্রহের আর্থিক সামর্থ্য থাকবে না। বাংলাদেশের মতো ছোট কিন্তু অতিবর্ধনশীল জনসংখ্যার দেশে খাদ্যসমস্যা গুরুতর সংকটের রূপ নিতে পারে আগামী তিন-চার দশকের মধ্যেই।

দ্বিতীয়ত, পানির প্রাপ্তি। পৃথিবীর ৭৫০ কোটি মানুষের মধ্যে এখনই ২৭০ কোটি মানুষ নানা মাত্রার পানিসংকটের মুখোমুখি। আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য, সাব-সাহারান আফ্রিকাসহ পৃথিবীর বেশ কিছু অঞ্চলে পানি নিয়ে বিরোধ-সংঘাত চলছে। দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদেরও পানির সমস্যা কম নয়। ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের একটা বড় অমীমাংসিত সমস্যা হলো এ দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীগুলোর পানির ন্যায়ভিত্তিক বণ্টনের ব্যবস্থা আজও হয়নি। পানি নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেও বিরোধ রয়েছে। এমনকি ভারতের ভেতরেও বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে এ সমস্যা প্রকটভাবে রয়ে গেছে।

খাদ্য ও পানিই শুধু নয়, আরও অন্তত সাত ধরনের সমস্যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রকটতর হতে থাকবে বলে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিচ্ছেন। আমরা এ লেখায় সে প্রসঙ্গে যাব না; এ লেখার মূল প্রসঙ্গ হলো মানবজাতির এই বিপুল সংখ্যাধিক্য মানুষে মানুষে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটাতে পারে, সেসব পরিবর্তন সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফাম গত রোববার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে ৭০০ কোটি মানুষের মধ্য মাত্র আটজনের হাতে যে পরিমাণ সম্পদ জমে উঠেছে, তা পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক (৩৬০ কোটির বেশি) মানুষের মোট সম্পদের সমান। বলা হচ্ছে, এই আট ব্যক্তির মোট সম্পদের পরিমাণ ৪২ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমান। এদের মধ্যে ছয়জনই যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ।

তারা হলেন মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস, বার্সশায়ার হ্যাথাওয়ের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়ারেন বাফেট, আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেফ বেজস, ওরাকলের সহপ্রতিষ্ঠাতা ল্যারি এলিসন, নিউইয়র্ক শহরের সাবেক মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ এবং ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ।

অন্যদিকে ৩৬০ কোটির বেশি মানুষ, যারা মানবজাতির মধ্যে দরিদ্রতম, তাদের অধিকাংশের বসবাস আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশসহ তথাকথিত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। তবে উন্নত ও ধনী দেশগুলোতেও তারা আছে। যদিও পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী লোকেরা রাতারাতি ধনী হননি, যদিও শীর্ষ ধনী ব্যক্তিদের তালিকা প্রতিবছরই বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ পায়, তবু অক্সফামের প্রতিবেদনটি অতি অল্পসংখ্যক ব্যক্তির হাতে সীমাহীন পরিমাণ সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠার বিপরীতে বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্যের বিষয়টিতে আবারও দৃষ্টিপাত করার উপলক্ষ তৈরি হয়েছে।

ধনী ও দরিদ্র মানুষের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধির প্রসঙ্গটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন সংবাদ পোর্টাল দ্য হাফিংটন পোস্ট লিখেছে, অক্সফামের এই পরিসংখ্যান অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি ফুটিয়ে তোলার একটা সুস্পষ্ট উপায়। তারা এই বৈষম্য বৃদ্ধিকে ‘ডিস্টার্বিং’ বলে বর্ণনা করেছে।

অর্থনৈতিক বৈষম্য যে আরও নানা ধরনের বৈষম্যের অন্যতম প্রধান উৎস, তা নিয়ে বিতর্ক নেই। বৈষম্য কমানোর পক্ষে অনেক মানুষ কথা বলে, অনেক অর্থনীতিবিদ হিসাব করে দেখিয়েছেন, বৈষম্য বাড়ার ফলে প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধির যে সীমাহীন সুযোগ রয়েছে, সেটাই যে খোদ এই ব্যবস্থার বিপদ ডেকে আনতে পারে, এমন কথাও অনেকে অনেক দিন ধরে বলছেন।

নৈতিক বা মানবিক কারণে নয়, অনেকে বৈষম্য রোধ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিপদ এড়ানোর লক্ষ্যে। অক্সফাম ওই প্রতিবেদনে লিখেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বাড়তে দিয়ে তা বাড়তে বাড়তে এমন একপর্যায়ে যাবে, যখন আমাদের সমাজগুলো ভেঙে পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী যুগে যে সামাজিক বুনন গণতান্ত্রিক সমাজগুলোকে সংহত করেছিল, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য তা ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে পারে।

খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধির ফলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ব্যক্তির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া সম্ভব হয়েছে। একই কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে যুক্তরাজ্যের অধিকাংশ ভোটার। অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ার ফলে দেশে দেশে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও জাত্যভিমান, নানা ধরনের উগ্রপন্থী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, সাম্প্রদায়িকতা, অঞ্চলভিত্তিক বিরোধ-সংঘাত ইত্যাদি বেড়ে চলেছে।

বাংলাদেশও বৈষম্য বৃদ্ধির এই বৈশ্বিক প্রবণতার বাইরে নেই। এ শতকের প্রথম এক দশকের হিসাবে দেখা গেছে, এই দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি হারে বেড়ে গেছে। এ বিষয়ে ২০১০ সালের পরের আর কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না; তবে গত ছয়-সাত বছরে বৈষম্য কমেছে, এমন ধারণা অর্থনীতিবিদেরা করেন না। আমাদের জন্য অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি ইউরোপ-আমেরিকান সমাজের তুলনায় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বেশ কিছু কারণে।

প্রথমত, আমাদের দেশ জনসংখ্যার তুলনায় খুবই ছোট; এ দেশের জনঘনত্ব ইতিমধ্যে ‘প্যাথোলজিক্যাল বিহেভিয়ার’ সৃষ্টির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি খুব একটা কার্যকর নয়। সামাজিক সংহতি দৃশ্যত সন্তোষজনক মনে হলেও কখনো কখনো হঠাৎ শান্তি-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিশেষত ধর্মীয় সংখ্যালঘু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপন্নতা বিস্ময়কর মাত্রায় বেড়ে যায়।

কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্য সীমাহীনভাবে বেড়ে যাওয়া নিয়ে আমাদের দেশে কেউ তেমন চিন্তিত নয়। এটা যে চিন্তার বিষয়, তা-ও আমরা উপলব্ধি করি না। কিন্তু যারা দেশ পরিচালনা করেন, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করেন, নীতিনির্ধারণ করেন, তাদের উচিত এ বিষয়ে চিন্তা করা।  প্রথম আলো

মশিউল আলম: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

১৮ জানুয়ারি ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে