এক্সক্লুসিভ ডেস্ক: মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিবছরের মতো এবারও বিশ্বের দেশে দেশে মানবাধিকার বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ সংক্রান্ত ২০১৬ সালের প্রতিবেদনটি এবারে বেশ আলোচনায় এসেছে। কারণ বাংলাদেশ সরকার এটি প্রত্যাখ্যান করেছে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর কথায়, এটি সত্যের অপলাপ, যারা প্রস্তুত করেছেন, তারা তাদের ‘ঝাপসা চশমা’ দিয়ে কমই দেখতে পেয়েছেন। মানবজমিন পাঠকদের জন্য ওই প্রতিবেদনের কতিপয় নির্বাচিত অংশের অবিকল তরজমা তুলে ধরা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো প্রথম কিস্তি।
নির্বাহী সারসংক্ষেপ:
বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদী, সংসদীয় গণতন্ত্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের পর থেকে ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। ওই নির্বাচন অবশ্য অধিকাংশ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে বিতর্কিত এবং আন্তর্জাতিক মান থেকে দূরে রয়েছে।
নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর উপরে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
মানবাধিকার সমস্যার সব থেকে তাৎপর্যপূর্ণ সমস্যা হলো, বিচার বিভাগীয় হত্যা, একতরফা অথবা অবৈধ ডিটেনশন এবং গুমের ঘটনবালী, যা সরকারের নিরাপত্তাবাহিনীগুলো দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। প্রান্তিক গ্রুপগুলোর সদস্য এবং অন্যরা উগ্রপন্থার সমর্থক গোষ্ঠীদের দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এছাড়া রয়েছে আগাম ও জোরপূর্বক বিয়ে, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বিশেষ করে নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং কাজের পরিবেশের দুরবস্থা এবং শ্রম অধিকারের লঙ্ঘন।
মানবাধিকারের অন্যান্য সমস্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে; নিরাপত্তা বাহিনীগুলো দ্বারা নির্যাতন এবং নীপিড়ন, একতরফা গ্রেপ্তার, দুর্বল বিচার বিভাগীয় সামর্থ্য ও স্বাধীনতা, বিচারপূর্ব দীর্ঘ হাজতবাস, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতা, সরকারি দুর্নীতি এবং অনলাইন বক্তৃতা ও প্রেসের উপরে বাধা-নিষেধ আরোপ। কর্তৃপক্ষসমূহ নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকার ক্ষুণ্ন করেছে। কতিপয় বেসরকারি সংগঠন (এনজিও) অব্যাহতভাবে তাদের কার্যক্রমের ওপর আইনগত এবং অন্যান্য অনানুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ মোকাবিলা করছে। প্রতিবন্ধীদের বিরুদ্ধে বৈষম্য একটি সমস্যা। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী বাচ্চারা, কোনো সরকারি স্কুলে ভর্তি হতে গেলে তারা বাধার সম্মুখীন হয়। ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সামাজিক সহিংসতার দৃষ্টান্ত বিদ্যমান রয়েছে। লিঙ্গ ভেদাভেদের ভিত্তিতে সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে ব্যাপকভিত্তিক দায়মুক্তি সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। সরকার নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচারের বিষয়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এর অভ্যন্তরীণ তদন্ত সেলসহ কিছু সীমিত উপায়ে পদক্ষেপ নিয়েছে। পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ওপর জনগণের অনাস্থা এতটাই প্রকট যে, তাদের অনেকেই কোনো সরকারি সংস্থার লোকদের কাছে গিয়ে তাদেরকে তদন্তে সহায়তা কিংবা অপরাধ সংঘটনের বিষয়ে তথ্য দেয়া থেকে বিরত থেকেছে। বহুক্ষেত্রে সরকার উগ্রপন্থিদের আক্রমণে ভিক্টিমদের দোষারোপ করেছে। আর তাতে হামলাকারীদেরই দায়মুক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে।
সেকশন-১: ব্যক্তির প্রতি মর্যাদা
ক. একতরফাভাবে জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চনা এবং অন্যান্য বেআইনি কিংবা রাজনৈকি উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ড।
বাংলাদেশের সংবিধান জীবন এবং ব্যক্তির স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। মিডিয়া এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো রিপোর্ট করেছে যে, সরকার কিংবা তাদের এজেন্টরা বিপুল সংখ্যক একতরফা বা অবৈধ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে।
অভিযান, গ্রেপ্তার এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পদক্ষেপের ঘটনায় সন্দেহজনক মৃত্যু সংঘটিত হয়ে থাকে। বেশির ভাগ সময় নিরাপত্তা বাহিনীগুলো দাবি করে থাকে যে, তারা নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা কোনো একজনকে কোনো একটি ক্রাইম সিনে নিয়ে যায়। অস্ত্র উদ্ধারের জন্য গভীর রাতে কোনো একটা গোপন আস্তানায় নেয়ার ঘটনা ঘটে। কিংবা চক্রান্তকারীদের যখন শনাক্ত করে তখন সন্দেহভাজন ব্যক্তি হত্যার শিকার হয়, কারণ তখন নিহতের সমর্থক ষড়যন্ত্রকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। সরকার র্যাব বা কোনো পুলিশ ইউনিট এবং ক্রিমিনাল গ্যাং-এর মধ্যকার এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনাকে সাধারণত ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘এনকাউন্টার’ বলে উল্লেখ করে থাকে। যদিও মিডিয়া মাঝে-মধ্যে এসব পরিভাষাকে আইনগতভাবে বৈধ পুলিশের ক্ষমতা হিসেবে বর্ণনা করে থাকে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং মিডিয়া দাবি করে থাকে যে, বহু ক্রসফায়ারের ঘটনা প্রকৃতপক্ষে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। কিছুক্ষেত্রে মানবাধিকার সংগঠনগুলো দাবি করে থাকে যে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সন্দেহভাজনদের অন্তরীণ, জিজ্ঞাসাবাদ এবং নির্যাতন করার পরে যে স্থান থেকে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, সেই দৃশ্যপটে নিয়ে আসে। এরপর সেখানে তাকে হত্যা করা হয়। এবং তারপর দাবি করা হয়, ওই সন্দেহভাজনদের তরফে সহিংস হামলা মোকাবিলা করতে গিয়ে আইনসম্মত আত্মরক্ষায় গুলি চালাতে গিয়ে তারা নিহত হয়েছে। একটি মানবাধিকার সংগঠন রিপোর্ট করেছে যে, বছরের প্রথম নয় মাসে ‘ক্রসফায়ার’-এ ১৫০ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। এদের ৩৪ জনকে র্যাব, ১১ জনকে ডিবি পুলিশ, ১ জনকে বিজিবি, ৩ জনকে যৌথ সোয়াত অপারেশন এবং ৬১ জনকে পুলিশ বাহিনী ক্রসফায়ারে দিয়েছে। অন্য একটি মানবাধিকার সংগঠন রিপোর্ট করেছে যে, বছরের প্রথম নয় মাসে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো ১১৮ জনকে হত্যা করেছে।
২০১৫ সালের মতো ততটা বেশি সংখ্যায় বা ব্যাপকভিত্তিতে না হলেও, রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ড, ক্ষমতাসীন এবং বিরোধীদলীয় উভয় সদস্যদের তরফে অব্যাহত রয়েছে। একটি মানবাধিকার সংগঠনের মতে রাজনৈতিক সহিংসতায় ২০৯ জনের মৃত্যু ঘটেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর তরুণদের শাখাগুলো এবং ছাত্রদের দ্বারা সংঘটিত সহিংসতা একটি সমস্যা। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের মধ্যেও সহিংসতা ঘটে থাকে। জুলাই মাসে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়।
১০ মার্চ ২০১৭/এমটি নিউজ২৪ডটকম/এএস