বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৭, ০৭:০০:৩৮

বাংলা নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে আপত্তি কেন?

বাংলা নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে আপত্তি কেন?

নিউজ ডেস্ক : আগামীকাল উদযাপন করা হবে বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন, পহেলা বৈশাখ। নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে এই উৎসবটি পালন করা হয়, যার মধ্যে বর্তমানে উল্লেখযোগ্য একটি হচ্ছে, ঢাকার চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা।

গতবছর পহেলা বৈশাখ বরণ করে নেয়ার অপেক্ষাকৃত নতুন এই উৎসবটি ইউনেস্কোর অপরিমেয় বিশ্ব সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। স্বীকৃতির পর এবছর এটি আরো ব্যাপকভাবে পালনের উদ্যোগও এসেছে। যদিও এই উদ্যোগ নিয়ে আপত্তিও জানিয়েছে কিছু ধর্মভিত্তিক সংগঠন।

মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরু কীভাবে, এর বিশেষত্ব কী এবং এনিয়ে বিতর্কই বা কেন?

মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা এবছর ২৮ বছরে পা দিলো। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখের সকালে বাদ্যযন্ত্রের তালে নানা ধরণের বাঁশ-কাগজের তৈরি ভাস্কর্য, মুখোশ হাতে বের হয় বর্ণাঢ্য এই মিছিল।

চারুকলা থেকে এই শোভাযাত্রার শুরুটা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। যদিও সেটা তখন এতটা বর্ণাঢ্য ছিল না। তখনকার সেই শোভাযাত্রার একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নিজ-নিজ জায়গা থেকে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছিলেন অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক। কিছুটা সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে, বিশেষ করে চিত্রশিল্পীরা এই মঙ্গল শোভাযাত্রার পরিকল্পনা করেন।

চারুকলা অনুষদের বর্তমান ডিন, নিসার হোসেন তখন ছিলেন একজন তরুণ শিক্ষক। তিনি বলেন, তৎকালীন স্বৈরাচার সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করার বিপরীতে সব ধর্মের মানুষের জন্য বাঙ্গালি সংস্কৃতি তুলে ধরার চেষ্টা ছিল শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তারাই মূলত: এই আয়োজনটি করেছিল।

যদিও ঢাকার চারুকলার এই উৎসবটি বেশ সাড়া ফেলেছিল। তবে এটিই যে এধরণের শোভাযাত্রার একদম শুরু তা নয়। ১৯৮৫ সালে যশোরে চারুপীঠ নামের একটি সংগঠন এধরণের একটি শোভাযাত্রা করেছিল। যার উদ্যোক্তারা ঢাকায় মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনে ভূমিকা রাখেন এবং সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চারুকলায়ও মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরু হয়।

শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালক চিত্রশিল্পী মনিরুজ্জামান বলেন, "মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে আমরা একটি বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছি যে অশুভকে তাড়িত করে আমরা একটি শুভাগমন ঘটাতে চাই। এর একটা রাজনৈতিক প্রেক্ষিতও ছিল"।

শুরুতে অবশ্য আয়োজনের নামটা মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না। প্রথমবার সেটির নাম ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা। অধ্যাপক হোসেন বলেন, নামটা মঙ্গল শোভাযাত্রাই দেয়ার ইচ্ছে ছিল তাদের। কিন্তু তখনকার পরিস্থিতিতে এর ভুল ব্যখ্যা দেয়া হতে পারে এই আশঙ্কায় নামটি দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে এটি মঙ্গল শোভাযাত্রা নামেই পরিচিত হয়।

প্রতিবছর শোভাযাত্রার অন্যতম অনুষঙ্গ থাকে এসব বাঁশ এবং কাগজের তৈরি নানা ভাস্কর্য। যা তৈরি হয় কোন একটি প্রতিপাদ্যের ওপর ভিত্তি করে। এসব মুখোশ বা অন্যান্য মোটিফের যে কোন একটা বৈশিষ্ট্য আছে, সেটা শোভাযাত্রা দেখলে হয়তবা অনেকের চোখে পড়বে। মঙ্গল শোভাযাত্রার এই অনুষঙ্গগুলো আসলো কোথা থেকে?

"লোকসংস্কৃতির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ উপাদানগুলো বেছে নেয়া হয়েছিল। আমাদের সোনারগাঁয়ের লোকজ খেলনা পুতুল, ময়মনসিংহের ট্যাপা পুতুল, নকশি পাখা, যাত্রার ঘোড়া এসব নেয়া হয়েছিল"।

তিনি বলেন, শুরু থেকেই লক্ষ্য ছিল এই শোভাযাত্রাটিতে 'বাঙ্গালির ঐতিহ্য থেকে উপাদান নেয়া হবে এবং দেশের কল্যাণের জন্য একটি আহ্বান থাকবে'।

বাংলা বর্ষপঞ্জি

ষোড়শ শতকে যখন মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে বর্তমান বাংলা বর্ষপঞ্জি তৈরি হয়, তখন সেটি মূলত: ফসল রোপণ এবং কর আদায় সহজ করার উদ্দেশ্যেই করা হয়। হিজরি বর্ষ অনুযায়ী যেটা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল।

বাংলা বর্ষ ছাড়াও দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রায় একই সময়ে নানা নামে নতুন বছরের শুরু হয়। তবে শাসকরা যে উদ্দেশ্যেই বর্ষপঞ্জি করুক না কেন, এই নববর্ষ উদযাপনের সংস্কৃতিও বাংলায় বেশ প্রাচীন।

হালখাতা, মেলা, পিঠা-পুলি বানানো নানাভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপন হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। ১৯৬৬ সালে বাংলা বর্ষের গণনা সংস্কার করা হয়, এবং যার পর থেকে বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপন হয়ে আসছে ১৪ই এপ্রিল।

নববর্ষ উদযাপনের নানা উৎসবের মধ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রাটি একেবারেই নবীন। তাহলে জাতিসংঘের -ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা, ইউনেস্কো একে বিশ্ব সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃতি দিল কেন?

বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাংলাদেশে ইউনেস্কো কমিশনের সচিব মঞ্জুর হোসেন বলেন, বাচনিক ঐতিহ্য বা সামাজিক চর্চাসহ প্রাকৃতিক বা বৈশ্বিক চর্চার বিষয়গুলো বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ রয়েছে। এখানে দীর্ঘদিনের প্রথা হতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই।

বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত তিনটি বিষয়কে অপরিমেয় বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। ২০১৬ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং জামদানি বুনন শিল্পকে স্বীকৃতি দিয়েছে সংস্থাটি। এর আগে ২০০৮ সালে স্বীকৃতি দেয়া হয় বাংলাদেশের বাউল সঙ্গীতকে। ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতির পর সরকারও এবছর মঙ্গল শোভাযাত্রাকে আরো ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন।

তবে মঙ্গল শোভাযাত্রাও যে সবসময় বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল তা নয়। এই আয়োজন নিয়ে আগে থেকেই তাদের আপত্তি জানিয়ে আসছিল বিভিন্ন ইসলামপন্থী সংগঠন। তাদের দৃষ্টিতে, এই শোভাযাত্রাটি হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতি থেকে এসেছে এবং এবছর পহেলা বৈশাখ পালনের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারী নির্দেশনা দেবার পর তারা এর বিরোধিতা করেও আসছে।

কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব মুফতি ফায়জুল্লাহ তাদের আপত্তির কারণ হিসেবে বলেন, "এখানে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তির সাথে পেঁচার মূর্তিও বহন করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রার নামে। আমরা মনে করি এটি নিছক একটি হিন্দু ধর্মীয় রীতি এবং এটি মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক করার অধিকার কারো নেই"।

তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পহেলা বৈশাখ পালনের নির্দেশনা দেয়া হলেও মঙ্গল শোভাযাত্রা করার কোন বাধ্যবাধকতা দেয়া হয়নি বলে জানান মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এস এম ওয়াহিদুজ্জামান।

তিনি বলেন, "শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ না রেখে শুধুমাত্র ক্লাস সাসপেন্ড করে উৎসবমুখর পরিবেশে যাতে তারা দিনটি এবং ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা করতে পারেন, অনুষ্ঠান করতে পারেন। যার যার প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করবে, কোন বিশেষ নির্দেশনা নেই"।

মুফতি ফায়জুল্লাহ বলছিলেন, বাধ্যতামূলক করা না হলেও তারা এই শোভাযাত্রাকে হিন্দু ধর্মীয় উৎসব হিসেবেই দেখেন এবং এসংক্রান্ত সকল ন্যূনতম নির্দেশনায়ও তাদের আপত্তি রয়েছে।

কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজকেরা বলছেন, মঙ্গল শোভাযাত্রার সাথে কোন ধর্মীয় বিষয়ের সম্পর্ক নেই এবং যেকোন ধর্মের উৎসবের বাইরে বাঙ্গালি হিসেবে সার্বজনীন একটি উৎসব হিসেবেই সূচনা হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রার।

অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় বিভিন্ন শোভাযাত্রা অনেক আগে থেকেই হচ্ছে। আমাদের মহররমের সময় একটা শোভাযাত্রা হয়। জন্মাষ্টমীতে একটি শোভাযাত্রা হয়। কিন্তু যেহেতু সেগুলো ধর্মভিত্তিক শোভাযাত্রা, সেখানে ধর্মীয় বিষয়গুলোই থাকে। শোভাযাত্রার প্রথাটা বহু প্রাচীন। কিন্তু সব ধর্মের মানুষকে মেলানো যাচ্ছিল না। শোভাযাত্রার বিষয়টা এখানে নতুন না, নতুন হচ্ছে সার্বজনীনতা।

শিল্পী মনিরুজ্জামানও বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই নানা নামে আরো বড় শোভাযাত্রা আছে। কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রার বিশেষত্বই হচ্ছে এর সার্বজনীনতা। এই শোভাযাত্রার সাথে ধর্মকে মেলানোর মাধ্যমে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে তারা মত দেন।

তবে তর্ক-বিতর্ক যাই থাকুক না কেন, পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অপেক্ষাকৃত নতুন এই আয়োজনটি নিয়ে যে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে তা স্পষ্ট। একইসাথে ইউনেস্কোর স্বীকৃতির ফলে আন্তর্জাতিকভাবেও হয়তো এই শোভাযাত্রার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে।  বিবিসি।

১৩ এপ্রিল ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে