এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : প্রয়াত সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকা ব্রহ্মপুত্র নদকে ক্ষমা করতে পারেননি কখনই। কারণ তার জন্মস্থান আসামের সাদিয়া অঞ্চলটিকে প্রায় ধ্বংস করে ছেড়েছিল ১৯৫২ সালের প্রলয়ঙ্করী এক বন্যা।
ভূপেন হাজারিকার জন্মস্থান সাদিয়াতেই এখন নির্মাণ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম সেতুটি, যার কাজ প্রায় শেষের দিকে। সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৯৩৮ কোটি রুপি (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ হাজার ১৮০ কোটি টাকা)। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগামী মাসেই সেতুটি উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন।
ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী লোহিতের ওপর নির্মাণাধীন ৯ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও দুই লেনে বিভক্ত ঢোলা-সাদিয়া সেতুটি হতে যাচ্ছে ব্রহ্মপুত্রের ওপর নির্মিত দীর্ঘতম সেতু। উদ্বোধনের পর সেতুটিতে যান চলাচল শুরু হলে দুর্গম অরুণাচল প্রদেশের সঙ্গে ভারতের অন্য অংশের যোগাযোগ সহজ হবে। আসামের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে ৫৪০ কিলোমিটার দূরে সাদিয়া থেকে শুরু হয়ে সেতুটির অন্য প্রান্ত নামছে অরুণাচলের রাজধানী ইটানগর থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে ঢোলায়।
অরুণাচল প্রদেশে কোনো বিমানবন্দর নেই। ফলে দুর্গম অঞ্চলটিতে সড়কপথই যাতায়াতের বড় ভরসা। এখন পর্যন্ত আসামের সাদিয়া ও অরুণাচলের ঢোলা নগরীর মধ্যে নদীপথে যাতায়াতের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ফেরি। কিন্তু বর্ষাকালেও ঘাট ডুবে গিয়ে প্রতি বছর কয়েক মাসের জন্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়ে ফেরি চলাচলও। এ কারণে এ সময় অরুণাচল প্রদেশের তিনসুকিয়াসহ অন্যান্য স্থানে বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে যাতায়াত করতে হয় সাদিয়ার বাসিন্দাদের।
এছাড়া কাছেই চীন সীমান্ত হওয়ায় আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বাণিজ্যের দিক থেকেও ভারতের কাছে এলাকাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) বরাবর চীন এয়ারস্ট্রিপ সম্প্রসারণ করে চলায় ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাছে এ অঞ্চলের গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। এ অবস্থায় ২০১০ সালের শেষ দিকে সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু করে ভারত সরকার।
ভারতের সড়ক পরিবহন ও হাইওয়ে মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এবং নবযুগ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে চলছে সেতুটির নির্মাণকাজ। ঢোলা-সাদিয়া সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হলে আসাম ও অরুণাচল প্রদেশের মধ্যকার দূরত্ব কমবে অন্তত ৪ ঘণ্টার।
বর্তমানে পূর্ণোদ্যমে চলছে সেতুটির নির্মাণ কাজ। কাজও প্রায় শেষ দিকে। আগামী মাসেই সেতুটি উদ্বোধন হওয়ার কথা। আশ্চর্যের বিষয় হলো, দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম সেতু হলেও এ নিয়ে এখন পর্যন্ত সেভাবে কোনো হইচইয়ে মাতেনি ভারত সরকার।
বিষয়টি নিয়ে হইচই যত কম, সেতু বানানোর খরচ তার চেয়েও কম। ১২ দশমিক ৯ মিটার (৪২ ফুট) প্রস্থবিশিষ্ট সেতুটির স্প্যান সংখ্যা ১৮৩, যার প্রতিটির দৈর্ঘ্য ৫০ মিটার (১৬০ ফুট) করে। এছাড়া ঢোলা বাজার থেকে ইসলামপুর তিনিয়ালি পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে দুই লেনবিশিষ্ট একটি সংযোগ সড়ক। সব মিলিয়ে গোটা প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে মাত্র ৯৩৮ কোটি রুপি। অথচ সেতুটি এতটাই শক্তপোক্ত করে বানানো হচ্ছে যে, এর ওপর দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ট্যাংক ও গোলন্দাজ বহরও চলতে পারবে অনায়াসেই।
সেতুটির কাজ শুরু হয় ২০১০ সালের নভেম্বরে। ওই সময় আসামের ক্ষমতায় ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। কংগ্রেসের পরিবর্তে রাজ্যের শাসনভার বিজেপির হাতে এলেও প্রকল্পের কাজে বাধা পড়েনি এক তিলও। বাধা যতটুকু দেয়ার, তা দিয়েছে ওই ব্রহ্মপুত্রই।
মূলত ২০১৫ সালেই সেতুটি উদ্বোধন করার কথা ছিল। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র নদের প্রতিকূল আচরণের কারণে কাজ শেষের সময় পেছাতে হয়েছে কয়েক দফা। অস্থির ও প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র তার গতি বদলে চলে নিরন্তর, যা সেতুটি নির্মাণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শীতকালে নদের প্রস্থ দাঁড়ায় মাত্র আধা কিলোমিটার।
ভরা বর্ষায় কখনো কখনো নদের পানি এসে ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। হঠাত্ ঢলের তোড়ে সেতু নির্মাণে ব্যবহূত কয়েকটি ক্রেন পানিতে ডুবে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এর মধ্যে ২০১২ সালের বন্যায় পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল ঢোলা-সাদিয়া সেতুর গোটা নির্মাণ সাইটই।
ঢোলা-সাদিয়া সেতু নির্মাণ প্রকল্পে কর্মরত স্বায়ত্তশাসিত প্রকৌশল সংস্থা এসএন ভোবে অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের টিম লিডার প্রশান্ত ভট্টাচার্য বলেন, ‘ব্রহ্মপুত্র সবসময়ই তার গতিপথ বদলে চলে। ৯ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটির নকশা করার সময়ই আমাদের বিবেচনায় আনতে হয়েছিল, নদীর গতিপথ পরিবর্তন বা বন্যার সময় যাতে কোনোভাবেই এর পরিবহন ব্যবস্থা ব্যাহত না হয়। ২০১২ সালের বন্যার সময় আমাদের কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে ছয়-আট মাস। ওই সময় নির্মাণসামগ্রীসহ সাইটের সম্পত্তিও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
শুধু তা-ই নয়, বন্যার কারণে সেতুর সংযোগ সড়কও উঁচু করতে হয়েছে কয়েক দফায়। এছাড়া নদীর দুই পাড়েই ভূস্থলের দিকে বসাতে হয়েছে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাড ব্যাংক।
বর্তমানে একেবারেই চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে ঢোলা-সাদিয়া সেতুর নির্মাণকাজ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চলতি বছরের ১ জানুয়ারিতেই সেতুটি উদ্বোধনের কথা ছিল। কিন্তু নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় তা পিছিয়ে দেয়া হয়। নরেন্দ্র মোদিকে আগামী মাসে সেতুটি উদ্বোধনের জন্য চলতি সপ্তাহেই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোওয়াল। সর্বানন্দ সোনোওয়াল সম্প্রতি এক টুইট বার্তার মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
১৮ এপ্রিল ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এসএস