রবিবার, ১৪ মে, ২০১৭, ০৯:৪০:৪৭

নদীতে প্লেন পড়ে যাওয়ার পর যেভাবে বেচে গেলো ৩৬০ যাত্রী

 নদীতে প্লেন পড়ে যাওয়ার পর যেভাবে বেচে গেলো ৩৬০ যাত্রী

এক্সক্লুসিভ ডেস্ক:  ১৬০ জন আরোহী নিয়ে বিমানটি নিউইয়র্কের হাডসন নদীতে পড়ল। আরেকটু বিলম্ব হলেই বিমানটি বিধ্বস্ত হতে পারত। তাতে সব আরোহীর মৃত্যু ছিল নিশ্চিত। তবে বরফশীতল হাডসন নদী থেকে সব যাত্রীকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়াটাও কম কঠিন কাজ ছিল না। নিজের জীবনকে বাজি রেখে সেই দুঃসাহিক কাজে সহযোগিতা করেছেন সেই বিমানেরই এক যাত্রী ডেভ স্যান্ডারসন। রিডার্স ডাইজেস্ট থেকে কাহিনীটি তুলে এনেছেন আসিফ হাসান ]

বছরে আমি এক লাখ ৬৯ হাজার মাইল পাড়ি দেই বিমানে। তাই আকাশপথে অনেকটা সময় থাকা হয় আমার। ওরাকলে সেলস ম্যানেজার হিসেবে আমার কাজ শেষ করে দিনের শেষ ফ্লাইটে বাসার পথ ধরি। ১৫ জানুয়ারি নিউইয়র্ক থেকে নআসির্থ আসিফ ক্যারোলিনার চারলটে যাওয়ার জন্য বিকেল ৫টার ফ্লাইটের টিকিট করেছিলাম। তবে সেদিন সকাল সাড়ে ১১টার মধ্যেই কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল।

আমি ট্রাভেল এজেন্টকে ফোন করলাম এবং তিনি ইউএস এয়ারওয়েজের ৩টা ২৫ মিনিটের ফ্লাইটের ব্যবস্থা করলেন। আমার কাছে এটা ছিল প্রতিদিনের মতো বাড়ি ফেরার স্বাভাবিক একটা বিমান ভ্রমণ। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই বাড়ি গিয়ে স্ত্রী আর সন্তানদের সান্নিধ্য পাওয়ার কথা।
কিন্তু বিমানটি ওড়ার ৯০ সেকেন্ডের মধ্যে বাঁ দিকের ইঞ্জিনে বিস্ফোরণ ঘটল। আমি সেদিকেই ছিলাম। বিস্ফোরণের শব্দ শুনলাম ও জানালায় আগুন দেখলাম। তখনো বুঝিনি দু’টি ইঞ্জিনই বিকল হয়ে যাবে এবং বিমানটি ওড়ার সব শক্তি হারাবে।

ভয়ে জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। সবাই চার দিকে তাকাচ্ছিল কিন্তু কী করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। বিমানটি কিছু একটার ওপর দিয়ে উড়ে গেল, পরে একজন বলেছিল, সেটি ছিল জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজ। বিমানটি খুব নিচু দিয়ে উড়ছিল। আমি পানি দেখতে থাকলাম। নিউইয়র্কের আকাশচুম্বী ভবনরাজি আরো কাছাকাছি আসতে লাগল। চিন্তা করছিলাম, পাইলট বুঝি হাডসন নদীতেই বিমানটি নামাতে যাচ্ছে।

৩০ সেকেন্ড বা তারও কম সময়ের মধ্যে তিনি বললেন, শক্ত হয়ে থাকুন। আমি চার দিকে তাকালাম। কেউ শক্তভাবে হাত ধরে আছে, কেউ নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে, সৃষ্টিকর্তার প্রার্থনা করছে। আমিও সামনের সিট সজোরে আঁকড়ে প্রার্থনা করতে লাগলাম। ১০ সেকেন্ড পর বিমানটি পানি স্পর্শ করল।

আমি নিজেকেই বললাম, ‘আমি বেঁচে আছি। আমাকে এখান থেকে বের হতে হবে’। বাকি সবাই একই বিষয় ভাবছিল। ইতোমধ্যে বিমানে পানি উঠে গোড়ালি ডুবিয়ে দিয়েছে। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অন্যদের বের হতে সাহায্য করতে থাকলাম। নিশ্চিত হতে চাইছিলাম, কেউ যাতে বিমানে থেকে না যায়।

পেছনের দিকে এক মহিলাকে দেখলাম তার লাগেজ বের করতে। চিৎকার করে তাকে মন থেকে লাগেজের চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে বললাম। তিনি শুনলেন না। তিনি তার স্যুটকেস আর হাতব্যাগ নিয়ে বিমানের ভেজা ও পিচ্ছিল ডানায় নেমে এলেন। এতক্ষণে পরিস্থিতি বুঝতে পারলেন এবং দুটোই পানিতে ফেলে দিলেন। আমি তার হাতব্যাগটি উদ্ধার করলাম।

তখন আমার এক পা ছিল বিমানে, আরেক পা ডানায়। বিমানের ভাসমান লাইফবোটটি ছিল পুরোপুরি ভর্তি। বিমানটির দু’টি ডানাও লোকজনে পরিপূর্ণ। তারা ঠিকমতো পা-ও ফেলতে পারছিল না।

এক মহিলার কোলে তার নয় মাসের শিশু থাকায় তিনি লাইফবোটেও লাফ দিতে পারছিলেন না। তিনি অন্য কারো হাতে শিশুটিকে দিতেও ভয় পাচ্ছিলেন। আমি তাকে লাইফবোটের অন্য মহিলাদের কাছে শিশুটিকে ছুড়ে দিতে বললাম। কিন্তু তিনি সেটা করতেও ভয় পাচ্ছিলেন।

কিন্তু সেই পিচ্ছিল ডানা থেকে যেকোনো মুহূর্তে তার পানিতে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। আর বরফশীতল পানিতে পড়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু। নিউইয়র্কের তাপমাত্রা তখন মাইনাস ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা আরেকটু নামলেই পানি বরফ হয়ে যাবে। এই ঠাণ্ডা পানিতে কোনো মানুষ বড়জোর ১০ থেকে ১৫ মিনিট বাঁচতে পারে। শেষ পর্যন্ত মহিলাটি তার শিশুটিকে লাইফবোটে থাকা লোকদের দিকে ছুড়ে দিলো এবং তিনি নিজেও তাতে উঠলেন।

স্রোত ছিল প্রচণ্ড। আমার ভয় হচ্ছিল, লাইফবোটটি উল্টে যাবে। তাই আমি এক হাত দিয়ে বিমান আর অন্য হাত দিয়ে লাইফবোটটি ধরে রাখলাম। সাত মিনিট পর একটি ছোট টাগবোট এলো। ক্রুরা লাইফবোটে একটি দড়ি ছুড়ে দিলো। কিন্তু টাগবোটটি যখন তীরের দিকে চলতে শুর করল, তখন সেটি যেতে পারল না, বরং বিমানে ধাক্কা দিলো। আমার পিঠে বরফশীতল পানি আছড়ে পড়ল।

আমার মনে পড়ল টাইটানিকের সোজা সমুদ্রের পানিতে ডুবে যাওয়ার কথা। বিমানের ডানা থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। ততক্ষণে অবশ্য আরো নৌকা আসতে শুরু করেছে। নদীতে ঝাঁপ দিলাম। সাঁতরাতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু পায়ে শক্তি পেলাম না। শেষ পর্যন্ত দু’জন লোক আমাকে টেনে একটা নৌকায় তুলল।

কেউ একজন চিৎকার করে বলল, তুমি উঠে দাঁড়াও, হাঁটো। দাঁড়ালাম, কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। ঠাণ্ডায় প্রায় জমে গিয়েছিলাম। ঠাণ্ডায় আমি মরেও যেতে পারতাম।

ঘাটে ফিরেও আমি জমে যাওয়া অবস্থা থেকে মুক্তি পাইনি। রক্তচাপ ছিল অস্বাভাবিক বেশি। পরে আমার চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, আমার পা দু’টি রক্তশূন্য হয়ে পড়েছিল আর হৃদপিন্ড ও মস্তিষ্কে রক্ত বেড়ে গিয়েছিল। হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হওয়ার ভয়াবহ ঝুঁকিতে ছিলাম তখন।
যখন হাসপাতালে গেলাম, তখন আমার তাপমাত্রা ছিল মাত্র ৩৪.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গরম কম্বলে মুড়ে দেয়া হলো আমাকে। তখনই হাসপাতালের ধর্মযাজক এলেন এবং তার সাথে প্রার্থনা করলাম।

বিমান দুর্ঘটনাটি আমার পরিবারের ওপর ভালো প্রভাব ফেলল। আমার সন্তানরা আমাকে আগের চেয়ে বেশি ভালোবাসতে লাগল।

সেদিন আমাদের ওপর সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ ছিল। বিমান থেকে অন্যদের বের করতে সাহায্য করতে তিনি আমাকে সাহস দিয়েছিলেন। তিনিই আমাদের পাইলট চেসলে সালেনবারগারকে নিরাপদে পানিতে অবতরণ করার বুদ্ধি জুগিয়েছিলেন। ১৫৫ জন যাত্রী ও পাঁচজন ক্রু’র সবাই বেঁচে গিয়েছিল।


সেই বিমানে ১৬০ জন সাহসী লোক ছিল। নৌকাগুলোও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সবাই যদি ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি না করত, তবে অবস্থা ভিন্নও হতে পারত।
এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে