এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : ১৮ বছরের প্রাণোচ্ছল তরুণী তারিশি জৈন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের অর্থনীতি বিষয়ের ছাত্রী জুনের প্রথম দিকে ছুটি কাটাতে এসেছিলেন ঢাকায়।
গত বছরের ১ জুলাই তারিশি জৈন গিয়েছিলেন হলি আর্টিজান বেকারিতে। ভয়াবহ সেই রাতে জঙ্গিদের হাতে অন্যদের মতো নির্মমভাবে খুন হন তিনিও। জঙ্গিরা গুলি করে হত্যার পর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়েছে তাকে। নিহতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে তার শরীরে।
কানাডাপ্রবাসী তারিশির ভাই সঞ্চিত জৈনেরও ঢাকায় আসার কথা ছিল। কিন্তু ভিসা সমস্যার কারণে তিনি আসতে পারেননি। হলি আর্টিজানে হামলার একদিন আগে দিল্লিতে পৌঁছান সঞ্চিত। দুয়েকদিনের মধ্যেই পুরো পরিবারের যাওয়ার কথা ছিল ভারতের উত্তরপ্রদেশের ফিরোজাবাদের সোহাগবাদে, যেখানে তারিশির পৈতৃক বাসস্থান।
প্রিয় বোন তারিশির সেই করুণ মৃত্যুবার্ষিকীতে তার ভাই সঞ্চিত জৈন ছোট বোনকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি লিখেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। ইংরেজিতে লেখা সঞ্চিত জৈনের সেই আবেগঘন চিঠি বাংলা অনুবাদ করে তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য:
প্রিয় তারিশি,
একটা বছর হয়ে গেল তুই নেই। যখন ভাবি কী বলবো, মনের ভেতর কতো কথাই না জড়ো হয়। এত এত কথা বলতে ইচ্ছে করে যে, মনটা কেঁদে ওঠে। তুই জানিস কীভাবে আমি নিজেকে ফিরে পাই। এই চিঠিটা লিখছি কারণ তোকে হারানোর বেদনা থেকে আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাই।
তুই কেমন মানুষ ছিলি তা এই চিঠি লেখার পর পড়ে অনুপ্রাণিত হওয়ার জন্য লিখছি। হয়তো নিজেকে বদলানোর অনুপ্রেরণা নিতেই লিখছি। এমন সময়ে আমার চারপাশে থাকার কথা ছিল তোর আর তোর বন্ধুদের।
যদি বলি তুই আমার পৃথিবী তাহলে তা একটুও মিথ্যে হবে না। কিন্তু সেই পৃথিবীটা যদি তুই দেখতে পারতি! কোথায় নেই তুই! তোকে নিয়ে বলা যায় কারও কারও এমন অনেক গল্প আছে। সেগুলো তারা বলেও। তোর এক বন্ধু আমাকে একবার বলেছিল, ‘তারিশির সঙ্গে থাকা মানে নিজের ঘরেই থাকা।’
অন্যের স্বাচ্ছন্দ্যবোধের জন্য কখনও নিজের কথা ভাবিসনি তুই। স্কুল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন সহপাঠীরা এলে মানুষ যেমন করে, তোর মাঝে ছিল সেই প্রবণতা। তোর মধ্যে অন্যকে মনপ্রাণ দিয়ে আপন করে নেওয়ার দারুণ গুণাবলী ছিল। তোর কাছ থেকে প্রথম যে জিনিসটি শিখেছিলাম, তা হলো অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। জীবনে এমন একটা পৃথিবীর কল্পনা ছিল তোর, যেখানে আর কিছু না হোক অন্তত সহানুভূতিটুকু থাকবে।
আমি লক্ষ্য করেছি, নিজের কথা না ভেবে সবসময় অন্যকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দিতো তোর মন। অনেকের মনে হতে পারে, সহানুভূতি মানসিক ব্যাপার। এটা আসলে বিচারবুদ্ধিহীন ধারণা। অনেকে মনে করে, সহানুভূতি এবং স্বার্থপরতা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। কিন্তু জীবনে যাই হোক না কেন, তুই দেখিয়েছিস— কোনও উদ্দেশ্য ছাড়াই সহানুভূতিশীল হওয়া যায়।
সত্যিকার অর্থে সহানুভূতিশীলরাও পৃথিবীতে আছেন, আবার ভীরুরাও আছে। ভীরুরা যে কোনও পরিস্থিতিতে বর্বর হওয়ার জন্য অজুহাত হিসেবে অন্যদের হতাশার পেছনে থাকে। তোর কাছ থেকে শেখা আমার দ্বিতীয় শিক্ষা হলো বিদ্বেষের মুখেও নিঃস্বার্থপরতা।
তোর দৃঢ়চিত্ত ও উদ্যমী মনোভাবের বর্ণনা না দিলেই নয়। শেষ বছরটা তোর জন্য খুবই কঠিন ছিল। ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলিতে পড়াশোনার প্রথম বছর কাটানো, লিগামেন্ট ইনজুরি ও অস্ত্রোপচার, নতুন বন্ধুদের সান্নিধ্য, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ধরে রাখা এবং ক্যারিয়ার গড়া; সবই সমানতালে করেছিস। সামাজিকভাবে তোর বিরুদ্ধে জড়ো হয়েছিল একগাদা মত।
সবকিছু নিজগুণে দারুণভাবে সামলে উতরে গেছিস তুই। মনে পড়ে ছোটবেলায় থাইল্যান্ডে পাহাড়ে উঠতাম। পিছলে পড়ে যাওয়া আর হোঁচট খাওয়ার পরও কোর্স শেষ না করে তুই থামতি না। তোর এ দিকটি কখনও স্বীকার না করার অনুতাপে সবসময় পুড়বো। তোর কাছ থেকে পাওয়া চতুর্থ শিক্ষা হলো অধ্যবসায়। তোর প্রতি থাকল পরম সম্মান ও শ্রদ্ধা।
এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, তোকে দেবীতুল্য হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছি। আমার উদ্দেশ্য এটা নয়, কিন্তু কে জানে! তোর কাছ থেকে নেওয়া শিক্ষাগুলো এসবের চেয়ে অনেক বড়। তাই তোর রেখে যাওয়া ছোট ছোট বিষয়গুলো উল্লেখ নাও করতে পারি। নতুন কিছু খেতে কিংবা নতুন গান শুনতে তোর উচ্ছ্বাস ছিল ব্যাপক।
মা ও পাপা (বাবা) আমাদের জন্য যা করেছেন সেজন্য তাদের প্রতি সবসময় কৃতজ্ঞতাবোধ দেখেছি তোর মাঝে। তোর মধ্যে এই শিল্পমন ছিল; তোর কাছ থেকে শেখা পঞ্চম শিক্ষাটা হলো এই কৃতজ্ঞতাবোধ। জীবনে যাই পেয়েছিস সেজন্য তোর কৃতজ্ঞতাবোধ। এটি মনুষ্যত্বের আধ্যাত্মিক বিবর্তনের ক্ষেত্রে স্পষ্ট মাইলফলক।
কৃতজ্ঞতাবোধ, অধ্যবসায়, সহানুভূতি ও নিঃস্বার্থপরতা। তোর সঙ্গে কাটানো ১৮টি বছরকে ফিরে দেখলে নিজের প্রতিফলন খুঁজে পাই। কিন্তু তোর গুণাবলীগুলো পরিপূর্ণতা পেলো না। আমি নিশ্চিত, আগামীবার মা, পাপা ও আমি একসঙ্গে বসে পেছনে ফিরে আমরা চার জন যেসব সময় কাটিয়েছি সেগুলো ফিরে দেখবো। সেই সময় হয়তো তোর উদারতা এবং মহিমার আরও নতুন দিক খুঁজে পাবো এবং সেগুলো ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করবো।
তাই তোর গুণগুলো নিজের কাছে ও সারা পৃথিবীর সামনে শিক্ষণীয় দিক হিসেবে ভাগাভাগি করতে চেয়েছি। সম্ভবত ভবিষ্যতে তোর মতো আন্তরিক ও সত্যিকারের মহানুভব লোক, যারা জীবনে উদ্দীপনা ও সত্যিকারের মহত্ব প্রত্যাশা করে তাদের জীবন কেউ কেড়ে নেবে না। সামনের দিনগুলোতে অন্যদের মাঝে তোর মতো মন, তোর মতো গুণগুলো খুঁজবো। প্রয়োজনে তাদের যে কোনোভাবে সহায়তা করবো। এটাই ‘লিভ লাইফ লাইক তারিশি অ্যাওয়ার্ড’-এর মর্মকথা। এটা কেবলই শুরু।
তারিশি, তোর শিক্ষাগুলোর জন্য ধন্যবাদ। জানি এগুলোর একটা না একটা প্রতি মুহূর্তে অবলম্বন করে চলি তোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। তারিশি, আমি তোকে বাঁচিয়ে রাখবো।
ভালোবাসা,
তোমার ভাইয়া
জুলাই, ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এসএস