অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় : কবে কোন রাক্ষসীবেলায় কবি সোমক দাস পঙক্তিটি লিখেছিলেন ‘ভারতবর্ষ বাবাদের দেশ’। তার পরে ভারতবর্ষের উপর দিয়ে কত ঝড়-ঝঞ্ঝা-সুনামি-ভূমিকম্প বয়ে গিয়েছে, ‘বাবা’-কেন্দ্রিক হাঁচোরপাঁচোর এক সেন্টিমিটারও কমেনি।
তারও আগে পরশুরাম লিখেছিলেন ‘বিরিঞ্চিবাবা’ আর ‘লম্বকর্ণ’। দুই গল্পেই বাবা নামধারী দুই খপিশ জোচ্চোর কী ভাবে লোক ঠকায়, তার খতিয়ান রেখেছিলেন। এতদিন পরেও যদি বাবাদের দাপটে ভারতে তুফান ওঠে, তখন মনে হয় যে প্রগতির গল্পটা রাষ্ট্র ইনিয়ে বিনিয়ে শোনায়, তা আসলে একটা নির্জলা ঢপ। আর সেটা রাষ্ট্রও সম্যক ভাবে জানে।
সাম্প্রতিক কালে ভারতের সংবাদ শিরোনামে এসেছেন তিন ‘বাবা’। আসারাম বাপু, ওম স্বামী এবং গুরমিত রাম রহিম সিংহ। তিনজনেই রীতিমতো খপিশ। তিনজনের অপকীর্তি জানার পরে এই সব প্রগতি-টগতির ফাঁকা বুলি নিয়ে আর ভাবতে ইচ্ছে করে না।
‘স্বচ্ছ ভারত’ নিয়ে কেন্দ্র সরকার যতটা ভাবিত, এই সেক্টরের স্বচ্ছতা নিয়ে তার কাছে কোনও জবাব নেই। কোন আহ্লাদে এই ক্রিমিনাল কাটিং লোকজন জনগণের উপরে খবরদারি করেন। দুষ্কর্ম করে ধরা পড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত রাষ্ট্রের তরফে নিরাপত্তা পান। এই সব প্রসঙ্গ মাথায় ঘুরুৎ ঘুরুৎ করে।
একবার নজর বুলোনো যাক এই তিন স্বঘোষিত মহাপুরুষের কীর্তিতে।
আসারাম বাপু— দিব্বি দিন যাচ্ছিল বাবাজির। সারা দেশে ঘুরে ঘুরে প্রবচন আউড়ে রীতিমতো ফুলে ফেঁপে উঠেছিল বেওসা। আমদাবাদ ও পাটনাকে সেন্টার করে গড়ে উঠেছিল তার সাম্রাজ্য। কলকাতা শহরেও তার ফলোয়ার ছিল বিপুল সংখ্যায়। ইনিই সেই মহাপুরুষদের অন্যতম, যিনি ভ্যালেন্টাইনস ডে-র বিরোধিতা শুরু করেন। কিন্তু সবদিন সমান নাহি যায়।
২০১৩-এ ১৬ বছরের এক কিশোরী তার বিরুদ্ধে শারিরীক হেনস্থার অভিযোগ আনে। ভূত তাড়ানোর ঝাড়ফুঁকের অছিলায় বাপু তার উপরে অত্যাচার চালান বলে জানা যায়। পুলিশের সামনে বাপু প্রথমে হাজির হননি। তাঁর বিরুদ্ধে বলপূর্বক আটকে রাখা, সম্ভ্রমহানী এবং অপরাধমূলক কাজকর্মের মামলা আনে পুলিশ।
বাবা গ্রেফতার হন। অভিযোগকারিনী মেয়েটিকে বাপুর শিষ্যরা হুমকি দেয়। বাপুর এক চেলা আবার বিমান বন্দর উড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও দেয়। শেষমেশ বাবা শ্রীঘরে যান। কিন্তু বাপুর চেলারা ক্রমাগত হুমকি দিতে থাকে মামলার সাক্ষীদের।
ওম স্বামী— ইনি গোড়া থেকেই রঙ্গিলা। নিজেকে ‘সদাচারী সাই বাবা’ বলে ডাকেন। রিয়্যালিটি শো ‘বিগ বস’-এ তুলকালাম বাধিয়ে সংবাদ শিরোনামে আসেন। হোস্ট সালমান খানের সঙ্গেও হাতাহাতি, মহিলার হিসি ছোড়াছুড়ির অপচেষ্টা— কী না করেছেন ইনি। তারপরে পোশাকহীন সুন্দরীর সঙ্গে যোগ-ভিডিও তুলে আবার শিরোনামে। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। নিজের ভাইয়ের দোকান থেকে সাইকেল চুরি করতে গিয়ে বাবা এখন হাজতে।
গুরমিত রাম রহিম সিংহ— এই মুহূর্তে রাষ্ট্রশক্তিকেই কাঁচকলা দেখাচ্ছেন। প্রায় ৫ কোটি ভক্তের এই ‘বাবা’ একাধারে আধ্যাত্মিক গুরু, সমাজ-শোধক, অভিনেতা, পরিচালক, গায়ক ও নারীর সম্ভ্রমহানীকারক। সিনেমা বানান, গান করুন ক্ষতি নেই। কিন্তু তাই বলে সম্ভ্রমহানী! স্বঘোষিত এই বাবার নামে খুনের অভিযোগও রয়েছে।
ইনি ডেরা সাচ্চা সওদা নামে এক সংগঠন গড়ে তুলে ধামাল মচাতে শুরু করেন। জন্মসূত্রে শিখ হলেও শিখ পন্থের সঙ্গে তার সম্পর্ক মোটেও ভাল নয়। খতিয়ান বলছে, গুরমিত বাবার রাজনৈতিক প্রতিপত্তি যথেষ্ট। কংগ্রেস আমলে তিনি কী সব কলকাঠি নেড়ে জেড ক্যাটেগরির নিরাপত্তা আদায় করেন। ২০১৪ সালে বাবা দিক বদল করেন। তিনি হরিয়ানা অঞ্চলে বিজেপি-র ধামা ধরেন।
২০১৫-এও তার চেলারা বিজেপি-র হয়েই গলা ফাটায়। কিন্তু পাপ কোনও দিন আকাশে থাকে না। ২০০২ সালে তার বিরুদ্ধে সম্ভ্রমহানীর অভিযোগ আনেন এক সাধ্বী। ১৫ বছর পরে সেই মামলার রায়ে রাম রহিম দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। ইতিমধ্যে বাবার ভক্ত সংখ্যা ৫ কোটি ছাড়িয়েছে। তারা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে রাস্তায় নেমেছে এক বিশাল জনতা। খেলা গম্ভীর। এবেলা
এমটিনিউজ/এসএস