শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০১:৪৭:২৬

কক্সবাজারের উখিয়ায় বৌদ্ধ ও মুসলমানদের সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থান--এই বন্ধন শত বছরের

কক্সবাজারের উখিয়ায় বৌদ্ধ ও মুসলমানদের সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থান--এই বন্ধন শত বছরের

মাহমুদ আজহার ও ফারুক তাহের, উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে: মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের উখিয়া সীমান্তের দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার। সীমান্তের দুই পাড় এখন চরম উত্তপ্ত।
মিয়ানমারে এখন চলছে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান। সেই অভিযানে অংশ নিচ্ছে দেশটির বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বৌদ্ধ ভিক্ষুুরাও। জীবন বাঁচাতে অধিকাংশ রোহিঙ্গা কোনোমতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নিচ্ছে এই উখিয়াতেই। সীমান্তবর্তী এই উপজেলার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। উখিয়াতেই রয়েছে ছোট-বড় ৪০টি বৌদ্ধমন্দির ও বিহার। এখনো বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকের গায়ে একটি আঁচড়ও লাগেনি। বরং মুসলিমরা বৌদ্ধদের উপাসনালয়গুলো রীতিমতো পাহারা দিয়ে রেখেছে।

উপজেলার একটি গ্রামের নাম রাজাপালং। সবুজে মোড়া ছায়া-সুনিবিড় এই গ্রামটির নাম রাজাপালং পাহাড় থেকেই করা হয়েছে। ১৪ একর জুড়ে এই ছোট্ট রাজাপালং পাহাড়েই রয়েছে শত বছরের পুরনো একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা। তারও আগে থেকে রয়েছে দেড়শ বছরের প্রাচীন একটি বৌদ্ধবিহার। এই বিহারটি ‘জাদী’ বলেই পরিচিত সবার মুখে। এ ছাড়া একই ছাতার নিচে রয়েছে একটি বড় কবরস্থান ও বৌদ্ধ শ্মশান। সেখানে আরও আছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মহিলা মাদ্রাসা। আশপাশে ৪০টি বৌদ্ধ পরিবারও বসবাস করছে মুসলিম সমাজের সঙ্গে সম্প্রীতি বজায় রেখে।

কার্যত এই রাজাপালংয়ে দীর্ঘ প্রায় দেড়শ বছর ধরে অসাম্প্রদায়িক চিন্তার ভিত্তিতে সাম্য ও সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রয়েছে। এখনো মুসলিম ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে দেখা মেলে মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে বৌদ্ধ ভিক্ষুুকে। উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ ভ্রাতৃত্বের দায়বদ্ধতা থেকে একে অপরের পাশে দাঁড়ায়। জানা যায়, ২০১২ সালে পার্শ্ববর্তী উপজেলা রামুর বৌদ্ধমন্দিরে হামলা ভাঙচুরের ঘটনায় কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানেও মুসলিম-বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম উত্তেজনা দেখা যায়। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল রাজাপালং। এখানে মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে মাদ্রাসার ছাত্ররা পর্যন্ত বৌদ্ধমন্দির পাহারা দেয়।

শুধু রাজাপালং ইউনিয়নেই রয়েছে ১০টি বৌদ্ধবিহার। এমনকি  উখিয়া সদর ও আশপাশে থাকা অন্তত ৪০টি বৌদ্ধবিহারেও ছিল মুসলিমদের সতর্ক পাহারা। দুই একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা উঁকিঝুঁকি দেখা দিলেও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও মসজিদ-মাদ্রাসার ইমাম-শিক্ষকরা নিজ দায়িত্বে বৌদ্ধবিহার পাহারা দেন। দীর্ঘদিন ধরেই ধর্মীয় ভাবাবেগের ঊর্ধ্বে উঠে এখানকার মানুষে মানুষে অটুট রয়েছে সৌহার্দ-সম্প্রীতি আর ভালোবাসার নিবিড় বন্ধন। এই অসাম্প্রদায়িক ভাব ও সম্প্রীতি বজায় রয়েছে গ্রামের শিশু-কিশোর ও মুসলিম-বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের মাঝেও।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৮৬৭ সালে উখিয়ার রাজাপালং পাহাড়ের এক পাশে গড়ে ওঠে প্রাচীন জাদী বৌদ্ধবিহার। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও ‘অহিংসা পরম ধর্ম’ নীতিতে বিশ্বাসী কয়েকজন বৌদ্ধ ভিক্ষুু এখানে প্রাচীন দুটি বুদ্ধমূর্তি স্থাপন করে শুরু করেন তাদের ধর্মচর্চা। এর ২৩ বছর পর ১৮৯০ সালে একই পাহাড়ে প্রতিষ্ঠা হয় রাজাপালং এমদাদুল উলুম ফাজিল মাদ্রাসা। একই সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজাপালং জামে মসজিদ। পুরো পাহাড়টির জমিদাতাও একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। নাম তার মকবুল আহমেদ শিকদার। তিনিই প্রতিষ্ঠিত করেন মসজিদ-মাদ্রাসা। তখন থেকেই এই সৌহার্দ-সম্প্রীতির যাত্রা শুরু। বৌদ্ধবিহার ঘুরে দেখা গেছে, ভিতরে বিহার অধ্যক্ষ জ্যোতি অলংকার ভিক্ষুু কয়েকজন শ্রামনকে নিয়ে ধর্মীয় আচারে মগ্ন। তাদের পরনে ছিল ধর্মীয় গেরুয়া পোশাক।

স্থানীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কিছু লোকজনকেও দেখা যায় মন্দিরে। সেখানে একটি প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি, একটি প্রাচীন জাদী ও একটি কেয়াং লক্ষ্য করা যায়। মন্দিরের পাশেই দেখা যায় শ্রামনদের আবাসস্থল। পুরনো গাছ-গাছালিতে ভরপুর বৌদ্ধমন্দিরটি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এ সময় মন্দিরের খোঁজখবর নিতে আসেন কয়েকজন মাদ্রাসা শিক্ষক ও ছাত্র। তারা একে অপরের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলেন। বিহার অধ্যক্ষ জ্যোতি অলংকার ভিক্ষুু মাদ্রাসা শিক্ষকদের হাত ধরে উপাসনালয়ে নিয়ে যান। সেখানে কিছু সময় শিক্ষক ও ছাত্ররা অবস্থানও করেন। এ সময় কথা হয় বিহার অধ্যক্ষ জ্যোতি অলংকার ভিক্ষুুর সঙ্গে।

তিনি জানান, ‘বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান বাণী হচ্ছে জ্ঞান, মুসলিমদের শান্তি, হিন্দুদের সত্য ও খ্রিস্টানদের মানবতা। এই চারটি বিষয় নিয়েই আমরা মূলত ধর্মচর্চা করছি। পৃথিবীর যেখানেই এই চারটি বিষয় রয়েছে সেখানেই সংঘাত-হানাহানি ও মারামারি নেই। ’ মিয়ানমারে চলমান সহিংসতা প্রসঙ্গে জ্যোতি অলংকার ভিক্ষুু বলেন, ‘সেখানে কী হচ্ছে তা আমরা পরিপূর্ণ জানি না। তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগও নেই। সেখানে কে কী ভূমিকা রাখছে তা আমাদের জানা নেই। আমরা চাই বাংলাদেশে শান্তি ও সম্প্রীতি। এখানকার স্থানীয় সাধারণ মানুষ খুবই ভালো। এমনকি মসজিদ-মাদ্রাসার ছেলেমেয়েরাও শান্ত।

মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা এ কে এম আবুল হাছান আলী থেকে শুরু করে সব শিক্ষকই নিয়মিত আমাদের খোঁজখবর রাখেন। এখানে কোনো অসুবিধা নেই। ভবিষ্যতে কী হবে বলতে পারি না। ’ এই সময় ভিক্ষুুর পাশেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় জ্যোতি উত্তম শ্রামন, জ্যোতি সুনীতি শ্রামন, জ্যোতি জয় শ্রামন ও জ্যোতি শীলভদ্র শ্রামনকে। তাদের সঙ্গে দেখা যায় কয়েকজন অনাথ বৌদ্ধ শিশু। কয়েকজন মাদ্রাসার ছাত্রের সঙ্গে তারা গল্প করছিল। এ সময় শ্রামনরা জানান, তারা ভালো আছেন। এখানে নিয়মিত উপাসনা ও পালিভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়। মিয়ানমারে নানা সমস্যার কথা শোনা গেলেও এখানে কোনো সমস্যা নেই।  

সরেজমিন মসজিদ প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, বৌদ্ধবিহারের আশপাশে থাকা ফাজিল মাদ্রাসা, প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মহিলা মাদ্রাসায় ক্লাস চলছে। কিছুক্ষণ পর মসজিদ থেকে জোহরের আজানও শোনা যায়। ছাত্র-শিক্ষকদের অনেকেই নামাজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেখানে কথা হয় ফাজিল মাদ্রাসার সহকারী অধ্যক্ষ মৌলভী মোহাম্মদ হাসেম, অধ্যাপক মুহিব উল্লাহ ও অধ্যাপক মাহমুদুল হকের সঙ্গে। তারা জানান, আমাদের জন্মেরও আগে থেকে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে একই ছাতার নিচে মুসলিম ও বৌদ্ধরা নিজ নিজ ধর্ম পালন করে আসছে।

ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান হলে বৌদ্ধরাও আমাদের মাদ্রাসায় আসেন, আমরাও তাদের বিহারে যাই। তাদের অনেকেই আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক বন্ধুও। মিয়ানমারে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন করা হলেও আমাদের এলাকায় একজন বৌদ্ধের গায়ে আঁচড়ও লাগেনি। বরং আমরাই তাদের মন্দিরকে সতর্ক পাহারা দিয়ে রাখছি। মানুষে মানুষে এই সম্প্রীতির বন্ধন সব খানে বিরাজ হোক— এটাই চাই আমরা।-বিডি প্রতিনিধি

এমটিনিউজ২৪ডটকম/আ শি/প্রতিনিধি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে