বুধবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৭, ০১:১৬:২১

‘হাবিব স্যারই আমাদের দেবতা’

‘হাবিব স্যারই আমাদের দেবতা’

এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : পুলিশ সদর দপ্তরের অ্যাডিশনাল ডিআইজি (সংস্থাপন) হাবিবুর রহমান। তাঁর মাধ্যমে বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন আজ সমাজে মাথা উঁচু করে বসবাস করছে! বেদে সম্প্রদায়ের উন্নয়নের পর এবার কাজ করছেন হিজড়াদের উন্নয়নে। এ ছাড়া তিনি পুলিশের উন্নয়নেও কাজ করছেন। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে তাঁর এগিয়ে আসার গল্প জানাচ্ছেন সরোয়ার আলম।

‘হাবিব স্যারই আমাদের দেবতা’
সমাজে আমরা অবহেলিত। আমাদের দেখলেই বলা হয় আজেবাজে কথা। আবার কেউ কেউ দেখেন ভিন্ন চোখে। টাকার জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে হয়। এমন জীবন আর ভালো লাগে না। আমাদের এই অবহেলিত জীবনে দেবতার দূত হিসেবে পেয়েছি পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি হাবিবুর রহমান স্যারকে। তিনিই আমাদের ভাগ্য বদলে দিয়েছেন। হাবিব স্যারই আমাদের দেবতা! সমাজের আর দশটা লোকের মতোই আজ আমরা চলতে পারছি। ’ অকপটেই এসব কথা বলছিলেন হিজড়া সম্প্রদায়ের নেতা সাম্মি। তিনি বলেন, ‘স্যার আমাদের অন্ধকার জীবন থেকে আলোর পথে নিয়ে এসেছেন। আশুলিয়ায় আমাদের জন্য একটি বিউটি পার্লার করে দিয়েছেন। পার্লারটি এখন জমজমাট। সাভারের হেমায়েতপুরেও আরেকটি পার্লার করে দিচ্ছেন। তাঁর জন্যই আজ আমরা সমাজে আশ্রয় পাচ্ছি। ’

জানা যায়, পুলিশ সদর দপ্তরের এডিশনাল ডিআইজি হাবিবুর রহমান ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার থাকাকালে সমাজের অবহেলিত লোকজনের কল্যাণে এগিয়ে আসেন। তাঁর মাধ্যমে বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন আজ সমাজে মাথা উঁচু করে বসবাস করছেন। ওই  সম্প্রদায়ের লোকজনও তাঁকে দেবতা হিসেবেই চেনেন! বেদে সম্প্রদায়ের উন্নয়নের পর এবার হাত দিয়েছেন হিজড়াদের উন্নয়নে। এর মধ্যেই তিনি একটি বিউটি পার্লার তৈরি করেছেন। ‘উত্তরণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন’-এর উদ্যোগেই চলছে এসব প্রয়াস। তা ছাড়া তিনি পুলিশের উন্নয়নেও কাজ করছেন। ঢাকা জেলার তিনটি মডেল থানার উন্নয়নের কারিগরও তিনি। তাঁর বিশেষ অবদানের কারণেই থানাগুলোতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।

১৭তম বিসিএস ক্যাডার হিসেবে ১৯৯৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘সহকারী পুলিশ সুপার’ পদে যোগ দেন হাবিবুর রহমান। ২০০০ সালে ডিএমপিতে যোগ দেন। ২০০১ সালে আরএমপিতে সহকারী পুলিশ কমিশনার (সদর) হিসেবে পদায়ন হয় তাঁর। জাতিসংঘের শান্তি মিশন শেষে ২০০৯ সালে ডিএমপির উপপুলিশ কমিশনার হিসেবে যোগ দেন। ২০১১ সালে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব নেন। এডিশনাল ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে যোগ দেন পুলিশ সদর দপ্তরে। তাঁর গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের চন্দ্রদীঘলিয়া। তাঁর বাবার নাম মরহুম আব্দুল আলী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বেড়ে উঠেছেন তিনি। তাঁর একক প্রচেষ্টায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পুলিশ মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর’। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাবা সব সময় বলতেন সব মানুষকে সমানভাবে

দেখতে শেখ, দেখবে মানুষে মানুষে ব্যবধান অনেক কমে যাবে। ’ বাবার মতোই মানুষকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেন তিনি। স্কুল থেকে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কর্মজীবন—সবখানেই বাবার দেখানো পথেই হাঁটছেন এই স্বপ্নদ্রষ্টা।

এডিশনাল ডিআইজি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘তৃতীয় লিঙ্গ হয়ে জন্ম নেওয়ার পেছনে তাদের কোনো হাত নেই। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত হিসেবে সমাজের আর দশটা মানুষের মতো সাধারণ জীবন যাপন করবে, এমনটিই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সমাজের অনেকে তাদের বাঁকা চোখে দেখে। এমনকি পরিবার বা রক্তের সম্পর্কও তাদের মেনে নিতে চায় না। এ জন্য তাদের স্বাবলম্বী করে সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসতে চাচ্ছি। তারা সমাজস্বীকৃত যে ধরনের কাজ করতে পারে, সেভাবে দক্ষ হয়ে সমাজে স্থান পাবে। আশুলিয়ার বিউটি পার্লারের পর হেমায়েতপুরে আরেকটি পার্লারের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। যে কোনো সময় উদ্বোধন হবে। আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে, এসব কাজের মাধ্যমে হিজড়া সম্প্রদায়ের লোকজন স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে—এই প্রত্যাশাই করি। ’

সমাজের উন্নয়নের জন্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে কর্মমুখী করে তুলতে হবে। সে লক্ষ্যেই সাভারে বেদে সম্প্রদায়ের পুনর্বাসন ও তাদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় উত্তরণ ফাউন্ডেশন বিশেষ করে বেদেপল্লী ও হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ, বুটিক, কম্পিউটার ট্রেনিং, ফ্যাশন হাউস ও বিউটি পার্লারসহ নানা ধরনের কর্মসংস্থানমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। শুধু পুলিশ নয়, সাধারণ মানুষের বন্ধু হয়েই বেঁচে থাকতে চান তিনি। তিনি বলেন, ‘জনগণের আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া পুলিশের পক্ষে সেবার দরজা প্রসারিত করা সম্ভব নয়। আর সাধারণ মানুষের সহযোগিতা পেতে হলে পুলিশকেও তাদের কাছাকাছি ও পাশাপাশি থাকতে হবে। ’

জানা যায়, হিজড়া ও বেদেদের সঠিক জীবনধারায় ফিরিয়ে আনতে আশুলিয়ায় উত্তরণ নামের একটি বিউটি পার্লার, দর্জি ও কাপড়ের দোকান দিয়ে ব্যবসায় উৎসাহিত করা হচ্ছে। পার্লারের পরিচালক সাম্মি বলেন, ‘চলতি বছরের ৫ মে হিজড়াদের সমাজে স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপনের লক্ষ্যে পার্লার উদ্বোধন করেন হাবিবুর রহমান স্যার। এর আগে সাভারে ও আশুলিয়ায় বেদেদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ‘উত্তরণ বস্ত্র বিতান’ নামে দুটি দোকান উদ্বোধন করা হয়। হিজড়ারা সৌন্দর্যের পূজারি! সাজতে ও সাজাতে পছন্দ করে।

এ জন্য বিকল্প পেশা হিসেবে স্যার আমাদের জন্য বিউটি পার্লার খুলে দিয়েছেন। বিউটি পার্লারগুলো আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ এবং স্বপ্নের প্রজেক্ট। শতভাগ নিরাপদ সেবা দিয়ে দ্রুত সময়ে গ্রাহকের মন কাড়ার চেষ্টা করছি। ক্রেতার সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। সমাজে কারো কাছে আমাদের আর হাত পাততে হবে না। পর্যায়ক্রমে সারা দেশেই পার্লারের সংখ্যা বাড়ানো হবে। ’ পার্লারের সহকারী পরিচালক আঁখি জানান, ‘ডেকোরেশনের পুরো কাজই করেছেন স্যার। এখন শুধু আমরা দোকান ভাড়া দিই। মাসে আমরা প্রায় ২০ হাজার টাকা আয় করতে পারছি। ’

বেদেপল্লীতেও তাঁর উন্নয়নের ছোঁয়া
সাভারের পোড়াবাড়ির বেদেপল্লীতেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগিয়েছেন অতিরিক্ত ডিআইজি হাবিবুর রহমান। বেদেদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে একক প্রচেষ্টা চালিয়ে সফলতা পান তিনি। বেদে পরিবারের প্রায় সবাইকেই সেলাই মেশিনসহ নানা উপকরণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলেন। আবার অনেক তরুণীকে বিয়ে পর্যন্ত দিয়েছেন। কয়েক মাস আগে বেদে পরিবারের তিন কন্যা—মজিরন আক্তার, মাছেনা খাতুন ও লিমা বিবির বিয়ের কেনাকাটা থেকে কন্যাদান, অতিথি আপ্যায়ন—সব আয়োজনই করেন হাবিবুর রহমান। মজিরন আক্তারের বাবা মোস্তাকিন মিয়া ওই সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘অভাব-দারিদ্র্যের কারণে ন্যায়-অন্যায় ভুলতে বসেছিলাম। প্রকৃত বাবার দায়িত্ব পালন করছেন হাবিব স্যার। তিন বছর আগে মেয়ের বয়স যখন ১৫, তখনই চূড়ান্ত করা হয় বিয়ের সব আয়োজন। খবর পেয়ে ছুটে এলেন স্যার। বোঝালেন বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে। বললেন, বরকে যখন স্থিরই করে ফেলেছেন, দরকার নেই বিয়ে ভেঙে ফেলার। মুলতবি রাখেন। বয়স হোক। আমি নিজেই আয়োজন করে আপনার মেয়ের বিয়ে দেব। হলোও তাই। ’ এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত ডিআইজি হাবিবুর রহমান জানান, ‘বেদেরাও তো মানুষ। ওরা হয়তো না বুঝেই অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। আমাদের দায়িত্ব ওদের বোঝানো। ’

মডেল থানারও কারিগর তিনি
সাভার থেকে কালের কণ্ঠ’র স্টাফ রিপোর্টার তায়েফুর রহমান জানান, ঢাকা জেলার সাভার, কেরানীগঞ্জ ও ধামরাই থানাকে মডেল থানায় উন্নয়নের রূপকার এডিশনাল ডিআইজি হাবিবুর রহমান। ঢাকা জেলার এসপি থাকাকালে তিনি এসব উন্নয়নের কাজ করেন। থানাগুলো মডেল থানায় রূপান্তর হওয়ার আগে সাধারণ একজন মানুষের সঙ্গে পুলিশের আচরণ ছিল অন্য রকম। আর এখনকার আচরণ ভিন্ন ধরনের। সাভার মডেল থানার একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, গত পাঁচ-ছয় বছরে এ ধরনের অনেক অদৃশ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি থানায় দৃশ্যমান বা ভৌত অবকাঠামোগত অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ২০১০ সালের ১৪ জুলাইর আগে সাভার থানার রূপ দেখেছেন এবং এখন দেখছেন। সাভার মডেল থানার রূপ বদলের পেছনে পুলিশ বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের সব কর্মকর্তার অবদান থাকলেও মূল রূপকার হলেন হাবিব স্যার। তাঁরই একান্তিক আগ্রহে থানার চেহারাটাই পাল্টে গেছে।-কালের কণ্ঠ
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে