মো. আব্দুল আউয়াল, ঈশ্বরগঞ্জ (ময়মনসিংহ): সকালে নাস্তা করতে বসেছি পরিবারের সাথে এমন সময় দরজায় মৃদুস্বরে একটু আওয়াজ ভেসে এলো- 'মাগো আমারে কিছু দিবাইন।' দরজাটা একটু ফাঁক করে যা দেখলাম তাতে নিজের চোখেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এক হাতে ব্যাগ আরেক হাতে একখানা লোহার দণ্ড (রড) নিয়ে দাঁড়িয়ে নুব্জ্যদেহে কাঁপছিল এক বৃদ্ধা।
পরিচয় জানতে চাইলে তার দু’চোখ বেয়ে আশ্রু ঝরতে লাগল। অনেক চেষ্টার পর তাকে কিছুটা শান্ত করতে পারলেও তাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলছিলাম। বৃদ্ধার নাম ফুলজান বিবি। বয়স ১০৫-এর ওপরে। বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বড়হিত ইউনিয়নের নওপাড়া গ্রামে।
প্রতিদিন ভোরে বাড়ি থেকে উপজেলা সদরে আসেন ভিক্ষে করতে। সারাদিন মানুষের কাছে হাত পেতে যা পান তা দিয়ে বাজার করে রাতে বাড়ি ফেরেন তিনি। বাড়ি থেকে বের না হলে চুলা জ্বলে না। বয়সের ভারে একেবারে কুঁজো হয়ে গেছেন। এলোমেলো স্মৃতির পাতায় সহজে কিছুই মনে করতে পারেন না।
কেন ভিক্ষা করেন- এমন প্রশ্নে বের হয়ে এলো বেদনাদায়ক আরেক গল্প। ফুলজানের স্বামী খজ আলী মারা গেছেন অনেক দিন আগে। এক ছেলে ইসব আলী (৬৫) ছিল ফুলজানের ভরসা। পরের জমিতে ধান কাটতে গিয়ে চোখে আঘাত পেয়ে দুই চোখ অন্ধ হয়ে গেছে ইসব আলীর। গত তিন বছর ধরে অন্ধ হয়ে ঘরে বসে দিনযাপন করছেন ইসব। দিনমজুর ইসব আলীর স্ত্রীও কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। ইসব আলীর দুই ছেলে ও এক মেয়ে থাকলেও ওরা নিজেদের পেটের দায় মেটাতে বাড়িতে থাকেন না। মেয়েটি স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে ঘরে ফিরেছেন। স্বামী পরিত্যক্তা ওই মেয়ের কাজের টাকায় যে সংসারের সব সামলাতে কষ্ট হয়। তাই ফুলজানকে বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করেই জীবন চালাতে হয়।
ছেলে অন্ধ হওয়ার পর থেকে নিজের ও ছেলের জন্যে আহার যোগানোর একমাত্র পথ এখন এটাই। জীবনের ক্লান্তিলগ্নে এসেও ছেলে ও নিজের পেটের দায়ে ভিক্ষা করতে বাইরে বের হতে হয় শতবর্ষী ফুলজানকে।
ফুলজান বিবির জানান, তিনি এখন ঠিক মতো চোখে দেখতে পান না। হাঁটতেও অনেক কষ্ট হয়। তার পরেও প্রতিদিনি অন্তত ১০ কিলোমিটার পথ হাঁটেন তিনি। কিছু দূর গিয়ে বিশ্রাম নিতে হয়। নিজেদের কোনো সম্বল নেই। একমাত্র যে সম্বল ছিল সেই ছেলেও অন্ধ। তাদের দেখার মতো কেউ নেই। তিনি বয়স্ক ভাতা পান, তবে তা দিয়ে চলে না। তাই প্রতিদিন সকালে বাড়ি থেকে বের হন মানুষের দোয়ারে। ফুলজান বলেন, 'বাইততে (বাড়ি থেকে) ভিক্ষা করতে বাইর না অইলে (বের না হলে) কি কাইয়াম (খাব কি)? বাইত আমার কানা পুতটা কি খাইব?( ঘরে অন্ধ ছেলে সে কী খাবে) মেলা কষ্ট অয় অহন আর সহ্য করতাম পারি না। আমার মরন নাই, (মৃত্যু নাই) মরলে যদি একটু জিরাইতারি (বিশ্রাম নিতে পারি)।'
বড়হিত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহ্ জালাল ফরাজী জানান, বৃদ্ধা বয়স্ক ভাতা পান তবে তা দিয়ে তার সংসার চলে না। তার সাথে দেখা হলে এমনিতেই কিছু সহযোগিতা করি। অন্ধ ছেলেটিও যাতে ভাতা পায় সে জন্য চেষ্টা করব।
এমটিনিউজ২৪/টিটি/পিএস