পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে গরম বছর!
এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : শীতের মুখে উষ্ণ বার্তা৷ শীতকাল প্রায় চলে এসেছে আর এখন শোনা যাচ্ছে উষ্ণতম বছরের সংবাদ। জেনেবায় বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বুধবার জানিয়ে দিল, এই পর্যন্ত পৃথিবীর সবচাইতে গরম বছর হিসেবে রেকর্ডের খাতায় নাম উঠতে চলেছে চলতি বছরের। সেক্ষেত্রে অবশ্য ভাঙতে চলেছে মাত্র এক বছর আগে গড়া রেকর্ড৷ এই পর্যন্ত পাওয়া রেকর্ডে বলছে, পৃথিবীর 'উষ্ণতম' বছর হিসেবে ধরা হয় ২০১৪ সালকে৷ এ বার অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্ব জুড়ে তাপমাত্রার যে ধরণ, তাতে রেকর্ড ভাঙাটা মাত্র সময়ের অপেক্ষা, মনে করছেন বড় বড় বিজ্ঞানীরা৷ টাইমস অপ ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে এখবর দিয়েছে।
২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই সময়কালকে 'উষ্ণতম পাঁচ বছর' বলেও অভিহিত করেছে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা৷ একে মানুষের প্রভাবে বিশ্ব উষ্ণায়ন লাগামছাড়া, তার উপর এ বছরের শক্তিশালী 'এল নিনো', দুয়ে মিলে পৃথিবীর কোনায় কোনায় তাপমাত্রার পারদকে ঊর্ধ্বমুখে ছুটিয়ে ছেড়েছে৷ এবং এখানেই শেষ নয়, বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা কেবল- ২০১৫ নয়, গড় তাপমাত্রার উপর সর্বাধিক প্রভাব পড়বে আগামী বছর, ২০১৬-তেও৷ যার অর্থ হল, গরম আমাদের পিছু ছাড়বে না৷
এমনিতে আবহাওয়ার যা ধরন, তাতে উষ্ণতার রেকর্ড প্রতি বছর ভাঙাটাই বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ যেমন, প্রথম দশ উষ্ণতম বছরের যে তালিকা বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা তৈরি করেছে, তাতে একটি মাত্র বছর গত শতাব্দীর৷ বাকি ন'টিই বর্তমান শতাব্দীর৷ ১৯৯৮ সালে চরম তাপমাত্রার পিছনে হাত ছিল এল নিনো-র৷ এ বারও তাই৷ এল নিনোর প্রভাবে গোটা বিশ্ব বিধ্বস্ত৷ ভারতে বর্ষায় ১৪ শতাংশ ঘাটতি ছিল৷ খরায় বিপর্যস্ত বেশ কয়েকটি রাজ্য৷ একই অবস্থা মধ্য আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে৷
ব্রাজিলের একটা বড় অংশেও এক দশা৷ ইন্দোনেশিয়ায় বৃষ্টির অভাব এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে এখন থেকেই দানাবলের চিন্তা গ্রাস করেছে গোটা দেশকে৷ ঘটনা হল, এল নিনোর প্রভাবে ক্যালিফোর্নিয়ার মতো মার্কিন প্রদেশে বৃষ্টি বাড়ার কথা৷ কিন্তু ইদানীংকালের খরাগ্রস্ত প্রদেশ এল নিনোর সেই আশীর্বাদ পায়নি৷ আবার পেরু, আর্জেন্টিনায় এত বৃষ্টি হয়েছে, বন্যা সামলাতে বিপাকে সেখানকার প্রশাসন৷ সবমিলিয়ে পরিস্থিতি জটিলই করে তুলেছে এল নিনো৷
সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে, পেরু, ইকুয়েডর লাগোয়া প্রশান্ত মহাসাগরে পানির তলের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের অনেকটা উপরে উঠে যাওয়াকেই বিজ্ঞানীরা 'এল নিনো' নামে অভিহিত করেন৷ এরই প্রভাব পড়ে বিশ্বের তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থলে৷ জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দশ মাসের হিসেবে আবহবিদরা দেখেছেন, সমুদ্রের গড় তাপমাত্রা অন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে৷ এই রেকর্ডটা ২০১৪-র দখলে রয়েছে৷ কিন্তু আবহবিদরা নিশ্চিত, দু'মাস পর রেকর্ডটি হেসে-খেলে ২০১৫-র ঝুলিতে চলে যাবে৷ তুলনায় স্থলভাগের তাপমাত্রার বৃদ্ধি কিছুটা কম৷ তবে বিশেষজ্ঞদের অনুমান, স্থলভাগের গড় তাপমাত্রার নিরিখে প্রথম দশে অবশ্যই ঠাঁই পাবে ২০১৫৷
তথ্য বলছে, ১৯৬১-৯০-এর গড়ের তুলনায় ০.৬১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রা দেখা গিয়েছিল ২০১৪ সালে৷ এ বছর ইতিমধ্যেই তা ০.৭৩ ডিগ্রি বেশি৷ মনে করাহচ্ছে, শিল্পবিপ্লবের আগের সময়ের (১৮৮০-১৮৯৯) গড় তাপমাত্রার তুলনায় ২০১৫ সাল এক ডিগ্রিরও বেশি 'উষ্ণ' হতে চলেছে৷ উষ্ণায়নের চরম প্রভাবেও যা আগে কখনও হয়নি৷ স্বাভাবিক ভাবেই চিন্তায় পড়েছেন বিশেষজ্ঞরা৷ বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মহাসচিব মিচেল জারোদের কথাতেও ধরা পড়েছে হতাশা৷ এ দিন তিনি বলেছেন, 'পৃথিবীর জন্য সবই খারাপ খবর৷ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে৷ আমাদের কাছে সেই উপায় রয়েছে৷ কিন্তু এ ভাবে চললে ভবিষ্যত প্রজন্ম সেই সুযোগও পাবে না৷' ঘটনাচক্রে, আর ক'দিন পরই প্যারিসে বসবে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলন৷ তার আগে এই বক্তব্য চরমবার্তা হিসেবেই পৌঁছনোর কথা৷ বিশ্বের তাবড় তাবড় রাষ্ট্রনেতারা এই বার্তা পেয়েও যদি ব্যবস্থা না নেন, তা হলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি কোনও ভাবেই ঠেকানো যাবে না, বলছেন আবহবিদরা৷
এ বার গ্রীষ্মে তীব্র গরম প্রায় দুই হাজার লোকের প্রাণ কেড়েছে ভারতে৷ মে, জুন মাসে উত্তর ভারতে গড়ে ৪২ ডিগ্রি করে তাপমাত্রা ছিল প্রতিদিন৷ তাপমাত্রা পার করেছিল ৪৭-৪৮ ডিগ্রিও৷ এক দৃশ্য দেখা গিয়েছিল পড়শি পাকিস্তানেও৷ বর্ষা দেরিতে আসায় বিপদ আরও বাড়ে৷ তাপপ্রবাহের হাত থেকে ছাড় পায়নি ইউরোপ, মধ্য আফ্রিকা, পূর্ব-মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অংশও৷ এর পিছনে যতটা দায়ী এল নিনো, ততটাই দায়ী বায়ুমণ্ডলে রয়ে যাওয়া গ্রিনহাউস গ্যাস৷ জারোদের কথায়, 'বায়ুমণ্ডলে রয়ে যাওয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ৪০০ পার্টস পার মিলিয়ন ছাড়িয়েছে৷ এই বিপদ থেকে মুক্তির রাস্তা ক্রমেই কমে আসছে৷' অন্যদিকে, গত পাঁচ বছরে আন্টার্কটিক ওজোন হোলে খুব একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছিল না৷ এ বছর তাতেও বড়সড় বদল এসেছে৷ নাসা-র পর্যবেক্ষণ বলছে, আন্টার্কটিক ওজোন হোলের যা পরিবর্তন হয়েছে, তাতে ২০০০ ও ২০০৬ সালের পরই আসবে ২০১৫৷
সব মিলিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের যা বহর, তাতে 'উষ্ণ' থেকে 'উষ্ণতর' পৃথিবীই ভবিষ্যত্৷ সেখানে দাঁড়িয়ে ২০১৪-র রেকর্ড ভাঙবে ২০১৫, এতে আর আশ্চর্যের কী!
২৬ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই
�