মৌলভীবাজার : দিন যতই গড়িয়ে যাচ্ছে ততই হাকালুকি হাওরের চেহারা পাল্টিয়ে যাচ্ছে। হাকালুকি হাওর থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, প্রাণী এবং উদ্ভিদ শূন্য হয়ে পড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে হাকালুকি হাওর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১ হাজার ২০৩ প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ ছিল হাকালুকি হাওরে। প্রতিদিন ৪ লক্ষাধিক মানুষের খাবার যোগান হতো এখান থেকে।
তবে সম্প্রতি সেই ভাবে জেলেদের জালে মাছ আসছে না। হাকালুকি হাওরের ছোট-বড় ২৪০টি বিলের একই অবস্থা। অপরদিকে অবৈধ দখলে গেছে বিলের জায়গা। আর এসব জায়গায় গড়ে উঠছে অবৈধ বসতবাড়ি। ২০০১ সালে হাকালুকি হাওরকে সংকটাপন্ন ঘোষণা করে সরকার। ২০০৫ সালে সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে এ হাওর রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের স্বার্থে ‘উপকূলীয় ও জলাভূমি জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এক সময় এ প্রকল্পের কাজ গতি হারায়। সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার উত্তর ভাদেশ্বর ও শরিফগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জের ঘিলাছড়া, মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ভাটেরা, বরমচাল ও ভূকশিমইল, জুড়ীর পশ্চিম জুড়ী, জায়ফরনগর ও বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ, সুজানগর, বর্ণী ও তালিমপুরের বৃহদাংশ জুড়ে এর অবস্থান। এর মধ্যে মৌলভীবাজার জেলায় শতকরা ৭৫ ভাগ এবং বাকি ২৫ ভাগ হাওর পড়েছে সিলেট জেলায়।
এ দুটি জেলার মোট ৩৯ হাজার ৩২৩ হেক্টর জমি নিয়ে হাকালুকি হাওরের অবস্থান। সরকারি হিসাবে হাকালুকি হাওরে মোট বিলের সংখ্যা ২৩৮টি। এছাড়া হাওরের মাঝ দিয়ে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি নদীও বয়ে গেছে। বর্তমানে এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় মিঠা পানির হাওর হাকালুকি। এখানে বিরল প্রজাতির জলজপ্রাণী ও উদ্ভিদ রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে বাংলাদেশের জলজ প্রজাতির উদ্ভিদের অর্ধেকেরও বেশি এই হাকালুকি হাওরে জন্মে। অন্তত ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে এই হাওরে। এর মধ্যে হিজল, করচ, বরুন, আড়ং ও মাখন অন্যতম।
তবে বর্ষা মৌসুমে চারদিকে থৈ থৈ জলরাশির কারণে পর্যটকদের মনের মধ্যে এক অনাবিল আনন্দের ছোঁয়ায় শিহরণ দিয়ে যেত। এই হাওরে ১১২ প্রজাতির পরিযায়ী ও ৩০৫ প্রজাতির স্থানীয় পাখি রয়েছে। এদের মধ্যে বিরল প্রজাতির স্থানীয় পাখিও রয়েছে। এদের মধ্যে মদনটাক, প্যালাসেস ফিস, ঈগল উল্লেখযোগ্য। এই হাওরে রয়েছে ১২ প্রজাতির উভচর, ৭০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। যার বিরাট একটি অংশ আজ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বিলুপ্তপ্রায় এই প্রাণীগুলোর মধ্যে রয়েছে উদ বিড়াল, মেছোবাঘ, বাগডাশসহ আরও কয়েকটি।
এখানকার নদীগুলোতে এখনও মাঝে মধ্যে শুশুকের দেখা পাওয়া যায়। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে ১২ প্রজাতির কচ্ছপের মধ্যে ১১ প্রজাতির কচ্ছপ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ধুম কাছিমের দেখা মিলছে না। তবে আরও দু’এক প্রজাতির কচ্ছপ থাকার সম্ভাবনা থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে তাদের কোন সন্ধান নেই। এছাড়া হাকালুকি হাওরে এক সময় ১০৭ প্রজাতির মাছ ছিল। এর মধ্যে টিকে আছে ৬৫ প্রজাতির মাছ আর বিলুপ্তির পথে রয়েছে ৩৪ প্রজাতির মাছ। এখনও হাকালুকি হাওরে জালে ধরা দেয় বিরল প্রজাতির মধু পাবদা, কালি বাউশ, রানী, বাঘা গুতুম, মেনী, কাকিলা মাছ ইত্যাদি। অপরদিকে উকল-মাখনা, স্থল পদ্ম, লাল শাপলা, লাল সিঙ্গাইর, শতমূল, আকন্দ, প্যারাবহা, উলটকম্বল, মালাক্কা জাঙ্গী, পানি সরিষা উদ্ভিদ এখন রয়েছে বিপদসঙ্কুল অবস্থায়।
জীববৈচিত্র্যের অপূর্ব সম্ভার এ হাওর বিভিন্ন কারণে তার ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স হারাচ্ছে। কৃষি জমিতে আগাছানাশক, ছত্রাকনাশক, পতঙ্গ নিবারকের অবাধ ব্যবহার, অবৈজ্ঞানিক পন্থায় প্রাণী বিশেষ করে উভচর, পাখি, সরীসৃপ প্রভৃতি নিধনে হাওর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যের গুণাবলী হারাচ্ছে। এদিকে হাকালুকি হাওর পাড়ের বাসিন্দা, হাওর বাঁচাও, কৃষি বাঁচাও, কৃষক বাঁচাও সংগ্রাম কমিটির কেন্দ্রীয় সভাপতি ও স্থানীয় ভূকশিমইল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিন আহমদ বাদশা জানান, নানা কারণে হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাওয়ায় মৎস্য অভয়াশ্রম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
১৭.০৮.২০১৩/এমটিনিউজ২৪.কম/এসআইআর