শামীমুল হক : একদিকে চলছে নির্বাচনী প্রচারণা। অন্যদিকে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে জনমত গঠন। দুই নেত্রী চষে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশ। দুই নেত্রীর বিপরীতমুখী এমন প্রচার প্রচারণায় সর্বত্র চলছে আতঙ্ক।
সিলেটের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচন হবেই। কেউ ঠেকাতে পারবে না। অন্যদিকে আগেরদিন রাজশাহীর জনসভায় বিরোধীদলীয় নেতা বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচন হতে দেয়া হবে না।
এ অবস্থায় মুখোমুখি দুটি দল। কিন্তু দেশের মানুষ তাদের কথা শোনছেন। তাদের কর্মকাণ্ড দেখছেন। আর দিন দিন তাদের অনড় এই মনোভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন।
এক অনিশ্চিত যাত্রায় বাংলাদেশ। এ যাত্রায় সহযাত্রী যারা তাদের দিকে কেউ তাকাচ্ছেন না। দেশের সাধারণ মানুষকে তাই রাজনীতিকদের কর্মকাণ্ড দেখা ছাড়া কিছু করারও নেই।
তবে তারা উন্মুখ এ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেলিত। চিন্তিত। তারা যে শান্তি— চায়। তারা যে দেশকে এগিয়ে যেতে দেখতে চায়। এ কারণেই তারা পাঁচ বছর পর পর লাইন ধরে ভোট দেন। যে দল জয়ী হয়, তাদের আনন্দে তারা আনন্দিত হন। আর আশায় বুক বাঁধেন। এবার নিশ্চয় একটা কিছু হবে। দেশ তরতর করে এগিয়ে যাবে। আর কোনো হানাহানি হবে না। সবাই মিলে এক আওয়াজ তুলবে। দেশকে এগিয়ে নেয়ার আওয়াজ।
কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই তারা হতাশ হন। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের উগ্রতা তাদের ভাবিয়ে তুলে। ক’দিন আগেই যাদের আপনজন ভেবে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন, তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকেন। গ্রামের প্রচলিত কথাÑ আপনজন ভাত খেতেও দেখতে পারে না, আর লাথ খেতেও দেখতে পারে না। দুটোই তাকে যন্ত্রণা দেয়।
বাংলাদেশের মানুষ এমন যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছে এখন। তাদের গলায় মাছের কাঁটা বিঁধেছে। তা না পারছে গিলতে, না পারছে ফেলতে। দেশের এ সঙ্কটকালে তারা তাই ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। বিক্ষুব্ধ হচ্ছেন। কিন্তু কিছুই করতে পারছেন না। তবে আড্ডা কিংবা কোনো সভায় এর ঝাল মিটাচ্ছেন ক্ষোভ প্রকাশ করে। প্রতি পাঁচ বছর পর পর একদিন তাদের হাতে ক্ষমতা আসে। সেদিনই তারা দল বেঁধে দেখিয়ে দেন তাদের ক্ষমতা।
রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ সব কিছুরই প্রতিফলন ঘটায় ওই সেই দিন। দিনটি হলো ভোট দেয়ার দিন। সাম্প্রতিক সময়ে এ ভোট সঠিকভাবে দিতে পারবেন কিনা তা নিয়েও দেখা দিয়েছে সন্দেহ আর সংশয়।
সরকার আর বিরোধী দল এ ভোট নিয়েই দুই মেরুতে অবস্থান করছে। কি হবে সামনে? সবই অন্ধকার। গাঢ় অন্ধকার। এ অন্ধকার ভেদ করে আলো বেরিয়ে আসবে কি? এখানেই কথা।
ভোটের দিন দেশের মালিক জনগণ দল বেঁধে ভোট দেন। কারও জয়ে তারা উল্লসিত হন। ভাবেন, এবার বুঝি দেশ মহাসঙ্কট থেকে উদ্ধার পাবে। আমরা যাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠিয়েছি, তাদের হাত ধরে দেশ এগিয়ে যাবে তরতর করে।
হিংসা-প্রতিহিংসা থাকবে না। দলমত নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই যেই লাউ সেই কদু। আগের মতোই চলতে থাকে সব।
একেবারে গ্রামগঞ্জে সরকারি দলের নেতাদের দাপট, লুটপাট দেখে অবাক হন তারা। শুধু অবাকই নয়, ভীষণ কষ্টও পান। দুঃখ পান। আরও বেশি কষ্ট পান তাদের ভবিষ্যৎ ভেবে। শেষ মুহূর্তে যখন চোখের সামনে তাদের করুণ পরিণতি দেখে তখনও কষ্ট পান। কারণ তারাই ছিলেন এ সরকারের আপনজন। তারাই ভোট দিয়ে তাদের ক্ষমতায় পাঠিয়েছিলেন।
এ কারণেই এ আপনজনরা ভাত খেতেও যেমন দেখতে পারে না, তেমনি লাথ (লাথি) খেতেও দেখতে পারে না। নিজেরাই আবার নতুন আশা নিয়ে অন্য দলকে ক্ষমতায় পাঠান। কিন্তু এখন যে অবস্থা তারা কি সেই ক্ষমতা পাবেন? সর্বত্রই এখন এক প্রশ্ন? নির্বাচন কি হবে? নির্বাচন হলে সব দল কি তাতে অংশ নেবে?
রাস্তাঘাট, হাট-বাজার, গাড়ি-ঘোড়া, সড়ক-মহাসড়ক, বাস-ট্রেন সব জায়গায়ই একই কথাÑ নির্বাচন কি হবে? বর্তমান সরকারের শেষ সংসদ অধিবেশন চলছে। এ অধিবেশনে কি রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান হবে? সরকার কি তার অবস্থান থেকে সরে আসবে? যদি সরে না আসে তাহলে কি হবে?
বিরোধী দলই বা কি করবে? আগামী ২৪ জানুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন হবে। সংসদ অধিবেশন শুরুর দিন বৃহস্পতিবার স্পিকার তা জানিয়ে দিয়েছেন সংসদ সদস্যদের। এর অর্থ সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে সরকার।
অন্যদিকে বিরোধী দল হুঙ্কার ছাড়ছে, তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দেবে না তারা। এই যখন অবস্থা তখন জাতিসংঘ থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিভিন্ন দাতা দেশগুলো নড়েচড়ে বসেছে। এতোসব অবস্থার পরও সরকার টলছে না। তারা বিরোধী দল বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে।
অবস্থাদৃষ্টে এমনটাই মনে হচ্ছে। আর এ অবস্থাই সঙ্কটের কারণ। সরকারি দলের কোনো কোনো নেতা বলছেন, আমরা আলোচনা করতে সবসময় প্রস্তুত। আলোচনার জন্য কোনো প্রস্তাব নেই, কোনো উদ্যোগ নেই। তারপরও যখন বলে আমরা আলোচনার জন্য সবসময় প্রস্তুত, তখন মানুষ হাসে।
নানা কথা বলে। জনগণের এই কথা তো শোনার কেউ নেই। যাদের উদ্দেশ্যে এসব বলা তারা তো থাকেন চার দেয়ালের ভেতরে। তারা শুনবেন কি করে। এ সঙ্কটকালে কি করতে হবে?
মহল্লার মোড়ের চায়ের দোকানে মুরব্বিরা বসে আড্ডা দেন। তাদের একজন বললেন একটি গল্প। এটি এমনÑ এক লোকের একটিমাত্র পুত্র সস্তান। এ
সন্তানও তেমন চালাক নয়। তার রয়েছে বিশাল সম্পদ। যতই তার বয়স হচ্ছিল ততই তিনি চিন্তিত হয়ে পড়ছিলেন। এতো সম্পদ এ সন্তান কিভাবে দেখে রাখবে? বৃদ্ধ বয়স।
একদিন তার পুত্রকে ডাকলেন। বললেন, বাবারে আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। যেকোনো দিন মরে যাবো। মৃত্যুর আগে তোকে বলে যাই, খাবারের সময় লোকমায় লোকমায় মাছের মাথা খাবি। এতে বুদ্ধি বাড়বে। আর বিপদে আপদে তিন মাথাওয়ালার পরামর্শ নিবি।
এটি হলো মৃত্যুর আগে আমার অছিয়ত। এর কিছুদিন পরই মারা যায় বৃদ্ধ। পুত্রের মাথায় ঘুরতে থাকে তার বাবার দু’টি অছিয়তের কথা। তাই সে বাজারে গিয়ে বড় বড় মাছ কিনে আনতে থাকে। আর প্রতি ওয়াক্তে মাছের মাথা দিয়ে খাবার সারে।
এভাবে একদিন দু’দিন যায়। এরপর সপ্তাহ যায়। মাস যায়। জমানো টাকা শেষ। শুরু হয় পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তি বিক্রি। এ সম্পত্তি বিক্রি করে খাচ্ছে মাছের মাথা। এভাবে বছর কয়েক পর তার মনে হলো পিতা তো বলে গেছে সঙ্কটে পড়লে তিন মাথার কাছ থেকে পরামর্শ নিতে। এখন তিন মাথা কোথায় পাবো?
এমন মানুষ খুঁজতে খুঁজতে একদিন এক বাড়ির সামনে দেখতে পায় এক বৃদ্ধ তার মাথা দুই হাঁটুর ফাঁকে রেখে বসে আছে। বৃদ্ধ এতো বয়স্ক যে, তিনি কুঁজো হয়ে পড়েছেন। এতে দেখা যায় তার মাথা একটি। আবার হাঁটুকেও একটি মাথা বোঝা যাচ্ছে। ওদিকে কুঁজো হওয়ায় পিটের নিচ অংশ উপরে ওঠে গেছে। সেটাকেও একটি মাথা মনে হচ্ছে।
পুত্র মনে মনে বলে, পেয়ে গেছি। দৌড়ে যায় তার কাছে। ঘটনা খুলে বলে। মাছের মাথা খেতে খেতে তার সম্পদ যে শেষ হয়ে গেছে তা-ও জানালো বৃদ্ধকে। বৃদ্ধ সব শুনে বললোÑ বাবারে তুমি বুঝতে ভুল করেছো। তোমার বাবা তো বলেছে লোকমায় লোকমায় মাছের মাথা খেতে।
এর অর্থ ছোট মাছ খেতে। যেমন পুঁটি, মলা-ডেলা ইত্যাদি। যেগুলো লোকমায় লোকমায় খাওয়া যায়। তুমি বোঝার ভুলে সব হারিয়েছ। আর সময় থাকতে তিন মাথার পরামর্শ নিতে আসনি। কাজেই এর দায় তোমার।
এ দায় ঘাড়ে পড়ার আগেই আমাদের এ সঙ্কট থেকে উত্তরণে একজন তিন মাথাওয়ালা মানুষ দরকার। খুঁজে বের করতে হবে তাকে এখনই। সবশেষ করে খুঁজতে গেলে কোনো লাভ হবে না। তখন শূন্য হাতেই ফিরতে হবে। অতএব সাবধান। বার বার একই ভুল যেন আমরা না করি। একই ফাঁদে যেন আমরা পা না দেই। তাই এখনই, এখনই রাজনীতিকদের এগিয়ে আসতে হবে। সমাধানের পথ বের করতে হবে। এক মঞ্চে হাতে হাত রেখে বসতে হবে। একে অন্যের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে না রেখে মুখ বাড়িয়ে দিতে হবে। আর যিনি মুখ বাড়িয়ে দেবেন তিনিই ইতিহাসে নাম লেখাবেন।
১৯.০৯.২০১৩/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম