তবে আগামী প্রযন্মের কাছে ওই সব অমিয় বাণী পৌঁছে দেয়ার কথা ঠিকই মনে রেখেছে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার নওটিকা গ্রামের জুবায়ের আল মাহমুদ নামের এক প্রতিভাবান যুবক। তার ডাক নাম রাসেল। তিনি মূলত রাজশাহী ও নাটোরের ৪১ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিনে পয়সায় শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিলিয়ে গড়ে তুলেছেন বইপড়ার আন্দোলন। ‘আলোর মিছিল’ নামে তার এই বই পড়ার আন্দোলনের বর্তমান পাঠক সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি।
রাসেলের বাবা আশরাফ আলি একজন শিক্ষক ও মা লাভলী বেগম গৃহিনী। নিম্নমধ্যে বিত্ত পরিবার। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় রাসেল এখন বাংলাদেশ প্রেস ইনিস্টিটিউটে সাংবাদিকতা পোষ্ট গ্র্যাজুয়েশন করছেন। তার ইচ্ছে শিক্ষা বিট নিয়ে টিভি সাংবাদিকতা করা।
যেভাবে শুরু: ছয় বছর আগের কথা। রাসেল পড়াশোনার ফাঁকে বরেণ্য ব্যক্তিদের ছবি আঁকতেন। সেসময় তিনি অষ্টম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ভাষা সৈনিক সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। তবে ভাষা সৈনিক কারা তার সঠিক উত্তরই দিতে পারেনি ওই শিক্ষার্থী। তখনই রাসেল ভাবেছিলেন আগামী প্রজন্মের জন্য কিছু করতেই হবে। যে ভাবা সেই কাজ। রাসেল তখন বাংলাদেশের ভাষা সৈনিক থেকে শুরু করে জাতীয় নেতা, বীরশ্রেষ্ঠ, কবি-সাহিত্যিকসহ বিভিন্ন বরেণ্য মানুষের ছবি আঁকা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি সেই ছবিগুলো দিয়ে আসতেন বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শিক্ষকরা সেই ছবিগুলো শ্রেণীকক্ষের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখতেন। রাসেল ভাবতেন, মনীষীদের এই ছবিগুলো দেখে শিশুদের মনে হয়তো বড় হওয়ার স্বপ্ন জাগবে।
মূলত তখন থেকেই দেশগড়ার আন্দোলনে তিনি নেমে পড়েন। পরবর্তীতে ২০১০ সালের শুরু দিকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে কাজ শুরু করেন। কিন্তু গ্রামের মোড়ল প্রকৃতির কিছু ব্যক্তির বাধায় রাসেলের সেই আন্দোলন সফল হয়নি। তখন তিনি ভাবলেন একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তৈরী করার কথা। কারণ তিনি মনে করেন অনেকগুলো যুবক এক কাতারে আসলে মোড়লদের কালো থাবা সহজেই মোকাবেলা করা যাবে। শর্ত হলো সেচ্ছাসেবী সংগঠনটির সদস্য হতে হলে বইপড়ার একটি প্রতিযোগিতায় টিকতে হবে।
একমাসের ওই বইপড়া প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত ৬৭ জনের মধ্যে মাত্র ১৫ জন টিকতে পারল। একমাসে ২২টি বই পড়ে প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়ে রাসেল ওই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হন। কিন্তু বারবার বলা সত্ত্বেও ওই সংগঠনের কিছু সদস্য ধূমপান না ছাড়াই সেখান থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। মূলত এই সংগঠন গড়তে এসে বই পড়ার আনন্দ তাকে পেয়ে বসে। আর তখন থেকেই তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই পড়ার আন্দোলন গড়ার সিদ্ধান্ত নেন।
এরপর রাসেল রাজশাহীর বাঘা, চারঘাট ও নাটোরের লালপুর ও বাগাতিপাড়া উপজেলার বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখেন, প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়েই কম-বেশি বই আছে। কিছু বিদ্যালয়ে আলাদা পাঠাগারও রয়েছে, নেই শুধু বই পড়ার চর্চা। রাসেল ভাবেন এই সকল পাঠাগারের বন্ধ তালা খুলতে পারলেই প্রাথমিকভাবে তার আন্দোলন সফল হবে।
সেই ভাবনা থেকেই তিনি বিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে শিক্ষদের অনুমতি নিয়ে বন্ধুর মতো শিক্ষার্থীদের কাছে গেলেন। তাদের বোঝালেন, আমরা পৃথিবীর সব জায়গায় হয়তো জেতে পারব না, তবে বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে সহজেই সারা পৃথিবী ঘুরে আসতে পারি।
বাঘার আড়ানী এফ.এন বালিকা বিদ্যালয়ে দেয়াল পত্রিকার কাজ করছিলেন রাসেল। ছিপছিপে গড়নের এই যুবক বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মননে ধারণ করে বাংলাদেশটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সৃজনশীল চিন্তাধারা প্রতিটি শিক্ষার্থীর মনে জাগ্রত করাই মূলত তার বই পড়ার আন্দোলনের উদ্দেশ্য। কারণ তিনি মনে করেন, সৃজনশীলতা না থাকলে একজন মানুষ নিজের পরিবারের জন্য যেমন কিছু করতে পারে না, তেমনি পারে না দেশ ও সমাজের জন্য কিছু করতে। দেশটাকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য চাই সৃজনশীল মানুষ।
এ প্রসঙ্গে বাঘার দীঘা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহাজাহান আলী বলেন, বিনে পয়সায় রাসেল যেভাবে বিই বিলাচ্ছে সেটা সাধারণত কেউ করে না। তবে তার এই বই পড়ার আন্দোলনের ফলে আমার ছাত্র/ছাত্রীরা সাধারণ জ্ঞ্যানে অনেক এগিয়ে গিয়েছে।
নাটোরের লালপুর উপজেলার এমআর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, বর্তমান সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতিতে ভাল রেজাল্ট করতে হলে ছাত্র/ছাত্রীদের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি প্রচুর বাইরের বই পড়া দরকার হলেও আমরা নিজেরা তা দিতে পারিনা। সেই দিক থেকে রাসেল যেভাবে প্রতিবছর বই দিচ্ছে তাতে শিক্ষার্থীরা অনেক উপকার পাচ্ছে।
আলোর মিছিলের পাঠকরা কে কি শিখছে জানতে চাইলে আড়ানী মনোমোহিনী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রোজা বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনী তবে রাসেল ভাইয়ের বইপড়ে মুক্তিযুদ্ধ তথা দেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। সে পড়েছে মোস্তাক আহম্মেদের ‘মধ্যরাতের কান্না’ ড. জাফর ইকবালের ‘আমি তপু’ সুনিল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সোনালি দুঃখ’।
চারঘাটের বাসুদেবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষাথী দিপু বলেন, আমি আলোর মিছিলের এই স্কুল শাখার ক্যাপ্টেন। রাসেল ভাইয়ের দেয়া বই সবার মাঝে বিলি করতে আমার ভীষণ ভাল লাগে।
যেভাবে উদ্বোধন: রাসেল মূলত বাইসাইকেলে কাঁধে বইয়ের ব্যাগ চেঁপে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে বই দিয়ে আসেন। তবে তিনি যে বই গুলো দেন সেটা আর ফিরিয়ে নিয়ে আসেন না। কারণ তিনি মনে করেন, প্রতিবছর তার দেয়া এই বইগুলোই একদিন প্রতিটি বিদ্যালয়কে বড় লাইব্রেরিতে পরিণত করবে। বিদ্যালয়গুলোর যে সব শিক্ষার্থী বই পড়ার জন্য আলোর মিছিলের পাঠক হয়, তাদের নাম নিবন্ধন করাতে হয়। এ জন্য প্রথম বছর ২০ টাকা ও পরের বছর গুলোতে মাত্র ৫ টাকা দিয়ে নাম নবায়ন করতে হয়। নিবন্ধনের এই টাকা রাসেল তার ব্যক্তিগত কাজের জন্য নেন না। মূলত এই টাকা দিয়েও কেনা হয় বই। এরপর বছর জুড়ে প্রতিটি বিদ্যালয়ে চলে বই পড়ার প্রতিযোগিতা।
বছর শেষে বিদ্যালয়গুলোর গ্রন্থাগারিক শিক্ষকদের মধ্যে থেকে সেরা গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে সেরা পাঠকদের পুরস্কার দেওয়া হয়। আবার প্রতিটি বিদ্যালয়ে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সেরা নির্বাচন করা হয়। আর সকল বিদ্যালয়গুলোর কয়েক হাজার পাঠদের মধ্যে থেকে নির্বাচন করা হয় সেরা ১০ জন পাঠক। তাদের সকলকেই পুরস্কার হিসেবে দেয়া হয় বই।
রাসেল যেখান থেকে বই পায়: রাসেল রাজশাহী ও নাটোরের ৪১টি বিদ্যালয়ে কয়েক হাজার বই বিলি করেছেন। কিন্তু তিনি এই বই গুলো কোথায় পাচ্ছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে রাসেল বলেন, ২০০৯ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য রাজশাহী শহরে যাওয়ার পর থেকে আমি টিউশনি শুরু করি। পাশাপাশি বিভিন্ন ছাত্রাবাসে পাঠকচক্র তৈরীর মাধ্যমে বই পড়ার আন্দোলন গড়ে তুলি।
ছাত্রাবাসগুলোর পাঠকরা মাসে ২০ টাকার বিনিময়ে একেক জন ৪টি বই পড়ার সুযোগ পেত। সেখানে প্রায় ১০০ পাঠক ছিল। প্রতি মাসে তাদের কাছ থেকে প্রায় দুই হাজার টাকা এবং আমি টিউশনি করে যে টাকাটা পেতাম সেটা দিয়েই মূলত কেনা হয় বই। তাছাড়া আমি মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে বই ভিক্ষা করি। এভাবেও অনেকগুলো বই পেয়েছি।
আছে বাধা: জ্ঞানচর্চার এই আন্দোলন করতে নানা বাধার মুখে পড়তে হয় রাসেলকে। কোন কোন বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাকে বুঝতে চান না। আবার কোন কোন শিক্ষক তাকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথাও বলতে দেন না। তার পরও হাল ছাড়েন নি রাসেল। এমনও হয়েছে কোন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাঠক তৈরি করার পর বইও বিতরণ করা হয়েছে। তারপরও সেই বিদ্যালয় থেকে বই প্রত্যাহার করে নিয়ে আসতে হয়েছে, শুধু মাত্র কিছু শিক্ষকের গোঁড়ামির কারণে। এভাবেই তিনি গত পাঁচ বছর ধরে নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যেও দেশকে ভালবেসে চালিয়ে যাচ্ছেন সৃজনশীল মানুষ গড়ার এই আন্দোলন।
রাসেল বই পড়ার এই আন্দোলন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যও তিনি কাজ শুরু করেছেন। তিনি এখন বিভিন্ন পাবলিক ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠকচক্র তৈরী মাধ্যমে সৃজনশীল মানুষগড়ার আন্দোলনে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসার জন্য কাজ করছেন। ইতিমধ্যেই তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরী করেছেন একটি পাঠকচক্র। রাসেলের আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ফেসবুকে- ‘আলোরমিছিল’-সৃজনশীল মানুষ গড়ার আন্দোলন’ নামের একটি ফেন পেজ খোলা আছে।
ফেজবুক পেজের লিংক: https://www.facebook.com/pages/আলোর-মিছিল-সৃজনশীল-মানুষ-গড়ার-আন্দোলন/834269526618244
২৬ জুন ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএম/ডিআরএ